ঋণ পরিশোধে গড়িমসি বড় পাপ

মানুষকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে কোরআন-হাদিস এত বেশি মোটিভেট করেছে তা আসলে বলে শেষ করা যাবে না। মানুষকে ঋণ দেয়া অনেক বড় সওয়াবের কাজ জেনেও আমরা অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ আমল করতে পারি না।

এটা অনেক কঠিন একটি বাস্তবতা। কারণ আজকাল কাউকে ঋণ দিলে সময়মতো ফিরিয়ে দেয়া তো দূরের কথা পাওনাদার আরও মনে করিয়ে দিলে তাকে অপ্রত্যাশিত আচরণের স্বীকার হতে হয়। ঋণ দিয়ে সময়মতো পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো আরও দেনাদারের দ্বারে দ্বারে হন্য হয়ে ঘুরতে হয়। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ঋণ দিয়ে পেরেশানি আমদানি করার শিক্ষা পায়। যার দরুণ পরবর্তীতে তারা আর এ আমল করার সাহস পায় না।

দুঃখজনকভাবে,আমরা অনেকেই মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অকৃতজ্ঞ আচরণ করি। এমন একটা ভাব করি যেন মনে হয় পাওনাদারকে আমরা চিনিই না, যেন সে আমার পাওনাদারই না।

আমাদের যেখানে নিজেদের ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার মতো দুর্বলতা জেনে পাওনাদারদের সঙ্গে আরো সুন্দর ব্যবহার করার কথা, কোমল স্বরে কথা বলার কথা সেখানে আমরা অনেক সময় পাওনাদারের সঙ্গে দাম্ভিকতার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলি, কষ্টদায়ক আচরণ করে ফেলি, পাওনাদারের উপকারকে তুচ্ছ করে দেখি।

এমন আচরণই মানুষকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চরম নিরুৎসাহিত করে। তখন কোনো ভালো মানুষ ঋণ চাইলেও ঋণ পাওয়া থেকে সে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থাৎ ওই মন্দ মানুষটির মন্দ কাজের প্রভাব ভালো মানুষটির ওপরও পড়ে।

এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা হয়তো কারো কাছ থেকে হাজার দুয়েক টাকা ঋণ নিয়েছেন। পাওনাদারের সঙ্গে বারবার কথা ভঙ্গ করার পর যখন সে তার পাওনার কথা বলতে থাকে তখন তার সঙ্গে নমনীয় কণ্ঠে কথা না বলে উল্টো আরও রাগ দেখিয়ে অকৃতজ্ঞ স্বরে বলা হয়, কী-রে ভাই!

আমি তো তোমার কাছ থেকে আহামরি কিছু নেই নি। তোমার দু হাজার নিয়ে বিপদে পড়লাম নাকি! দু-লক্ষ তো আর নেই নি। কেবল দু’ হাজারই নিয়েছি। আর এই দু’হাজার নিয়েই তোমার এত ঘ্যানঘেনানি? বলছি তো দিয়েই দেব। এগুলো কোনো ব্যাপার নাকি! তুমি এত প্যাচাল করবে জানলে তোমার কাছ থেকে আমি ঋণ নিতামই না, মিয়া। এরকম কত মানুষ পড়ে আছে যাদেরকে বলতে দেরি, ঋণ দিতে দেরি করবে না। যত্তসব!

বুঝলেন, যারা পাওনাদারের সঙ্গে এমন দাপটে আচরণ করেন তারা অনেক বড় মাপের অকৃতজ্ঞ, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, অনেক বড় মাপের অকৃতজ্ঞ। এরা চরম অকৃতজ্ঞ বলেই অনায়াসে এতটা জঘন্য আচরণ করে ফেলতে পারে। প্যারামিটার দিয়ে যদি তাদের অকৃতজ্ঞতা পরিমাপ করা যেত তবে তারা দেখতে পারতো তাদের অকৃতজ্ঞতার লেভেল কতটা বিভৎস ছিল।

আরে ভাই! যে মানুষটি আপনার প্রয়োজনের সময় বলতে না বলতেই সাত পাঁচ না ভেবে আপনাকে বিশ্বাস করে ঋণ দিয়ে দিলো সে মানুষটিকে আপনি কীভাবে ছট করে অপমানের স্বরে এটা বলতে পারেন যে, তুমি আমাকে আহামরি কিছু দাও নি! মাত্রই তো দু’হাজার দিয়েছো!

এ ধরনের টক্সিক বাক্য যে কতটা কঠিন তার যদি কোনো শরীরি রূপ দেয়া যেত তবে আপনি দেখতে পেতেন কতটা ভয়ঙ্কর কথা আপনি তাকে বলেছেন, কতটা বিষাক্ত তীর পাওনাদারের হূদয়ে নিক্ষেপ করেছেন। বুঝতে পারতেন তাকে কত শক্ত আঘাত করা হয়েছে।

এমন কঠিন আচরণের স্বীকার হওয়া পাওনাদারের হূদয় যদি বুক চিড়ে দেখানো যেত তবে আপনি হয়তো দেখতে পেতেন যে, আপনার বিষাক্ত কথার আঘাত তার হূদয়কে কতটা বিধ্বস্ত করেছে, কতটা বেশি রক্তক্ষরণ করেছে। আফসোস!

মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার আগে আমাদের এসব উপলব্ধি হয় না, এসব আমাদেরকে ভাবিয়েও তুলে না। নতুবা মানুষের সঙ্গে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ, এতটা কড়া রিঅ্যাক্ট আমরা করতে পারতাম না। আমার রিঅ্যাকশনের পর মানুষটির ভেতরকার অবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে একটু হলেও চিন্তা করতাম।

যে মানুষটি নিজের প্রয়োজনকে বিবেচনা না করে আপনার প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিলো, সে মানুষটির সঙ্গে আপনি কীভাবে এতটা নির্দয়সুলভ আচরণ করতে পারেন? যে মানুষটি আপনার প্রয়োজনের সময় তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আপনার উপকার করলো, আপনার পাশে দাঁড়ালো সে মানুষটির সঙ্গে কীভাবে আপনি অনায়াসে অপমানসূচক বাক্য ব্যবহার করতে পারেন?

আপনার কি তাতে একটুও বিবেকে বাঁধে না? আপনার প্রতি তার উপকার করা আপনার অন্তরে কি তার প্রতি এতটুকুও দয়ার সৃষ্টি করে না? তার সেই উপকার কি তার প্রতি নূন্যতম সম্মান প্রদর্শন করার দাবি রাখে না?

আপনার নিজের বেলায় যদি কেউ আপনার সঙ্গে এমন আচরণ করে তবে আপনার কেমন লাগবে, একটু ভাবুন তো! পারবেন কি তখন আপনার পাওনাদারের কড়া আচরণ সহ্য করতে? যা নিজের বেলায় সহ্য করতে পারবেন না তা অন্যের বেলায় করে যাওয়া কি আপনার মুসলমানিত্বের শিক্ষা?

আপনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে নবীজির (সা.) উম্মত দাবি করছেন, যে নবীজির (সা.) আশেক বলে দাবি করছেন, যে নবীজির (সা.) শাফায়াত লাভের আশায় বসে আছেন সেই নবীজি (সা.) পাওনাদারের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিলেন তা কি আপনার জানা আছে?

বিশ্বাস করুন, পাওনাদারের সঙ্গে আমাদের নবীজির (সা.) আচরণ দেখে আপনার অশ্রুসিক্ত হওয়ার কথা যদি না আপনার হূদয় পাথরের চেয়েও ভয়ঙ্কর শক্ত থাকে। তখন আপনার পাওনাদারের সঙ্গে আপনার কুৎসিত আচরণের কথা ভেবে লজ্জায় আপনার মাথা নিচু হয়ে আসার কথা। এমনকি পাওনাদারের কাছে গিয়ে লজ্জিত হয়ে অনুতপ্ত হূদয়ে করজোরে মাফ চেয়েও আসার কথা।

Exit mobile version