কর্মহীন অর্ধ লক্ষ পোশাক শ্রমিকের মানবেতর জীবনযাপন

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ৫ আগস্টের ক্ষমতার পতনের পর সারা দেশেই সরকারি-বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ অস্থিরতার প্রভাব সব চেয়ে বেশি পড়েছে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্পে।

দেশের পোশাক শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভার শিল্পাঞ্চল। ৫ আগস্টের পূর্বে এসব শিল্প এলাকায় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও কারখানাগুলো সচল ছিলো। তাই অনেক কারখানায় বেতন-ভাতা প্রদানে গড়িমসি থাকলেও শ্রমিকেরা দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে পড়ে চলতে পেরেছে।

তবে ২০২৪ এর ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার ক্ষমতা পতনের পর থেকেই বিভিন্ন জটিলতা দেখিয়ে অনেক পোশাক কারখানা হঠাৎ করেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

 

মালিকদের এ সিদ্ধান্তের ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের ৩ শিল্পাঞ্চলেই হাজার-হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নারী পোশাক শ্রমিকেরা বিভিন্ন উপায়ে এক শিল্পাঞ্চল থেকে অন্য শিল্পাঞ্চলে চাকরি পেলেও হাজার-হাজার পুরুষ শ্রমিকেরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নিরূপায় হয়ে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প গ্রুপের শ্রমিকেরা পেটের দায়ে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে গণসমাবেশ করছেন। রাজপথে আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গাজীপুরে শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর গত পাঁচ মাসে ৫১টি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৪১টি কারখানা স্থায়ীভাবে এবং ১০টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। এ ছাড়াও গাজীপুরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকায় অবস্থিত আরেক শিল্প গ্রুপ কেয়া আগামী মে মাস থেকে এই গ্রুপের আরও সাতটি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। গাজীপুরে স্থায়ীভাবে ৪১ টি কারখানা বন্ধের পর থেকেই হাজার-হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেকার হয়ে পড়া অনেক শ্রমিক বিভিন্ন কর্মের ব্যবস্থা করতে পারলেও কমপক্ষে ১০/২০ হাজার শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে।

 

বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক কারখানায় চাকরি করেন অপরেটার সুমন মোল্লা বলেন, সারা দেশের মানুষ সবাই এখন জানে, এই গ্রুপের পোশাক শ্রমিকেরা বেতনের জন্য রাস্তার রাস্তায় ঘোড়াছে। এখন কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। তিনি আরও বলেন, অনেকের বড় সংসার হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

অপর দিকে গাজীপুরের পরে দেশের আরেক বৃহত্তর পোশাক শিল্পাঞ্চল সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে ১৭টি কারখানা ৫ আগস্টের পর বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারখানায় কর্মরত হাজার- হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অন্য কোথাও চাকরি না পেয়ে বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রভাবে মহাসড়কে চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন-দিন খারাপ হচ্ছে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২-এর পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত ৫১টি শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারমধ্যে ১০টি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, এসব কারখানার মালিক চাইলে যেকোনো সময় খুলে দিতে পারেন।

এদিকে গাজীপুর শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, জেলায় ছোট-বড় মিলে মোট ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানার মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে ১ হাজার ১৫৪টি। গত নভেম্বর থেকে ৩৫টি কারখানা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেনি। ডিসেম্বর থেকে ৪৫ শতাংশ কারখানার বেতন বকেয়া পড়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর মহানগরের সভাপতি শফিউল আলম জানান, অর্থনৈতিক সংকট এবং মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের উচিত শ্রমিকদের সড়ক থেকে আলোচনার টেবিলে আনার ব্যবস্থা করা। তিনি আরও বলেন, হাজার-হাজার পোশাক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

Exit mobile version