ব্যক্তি তসলিমানাসরিনকে নিষিদ্ধ করে তো লাভ নাই। তসলিমানাসরিন যদি দেশে থাকতেন তবে তিনবেলা ভাত খেতেন, বাজারে যেতেন, কয়েকজন পুরুষের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন কিংবা টিভি-মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতেন- এর চেয়ে বেশি কিছু দৈহিকভাবে মানুষের করার ক্ষমতা আছে? যে কারণে তসলিমা বিরোধিতা, লেখিকাকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল? নিষিদ্ধ চিন্তার বিস্তৃতি আদতে থামে কি? বরং তসলিমানাসরিন দেশে থাকলে তার বই নিয়ে আলোচনা আরও কম হতো।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষত আওয়ামীলীগ-বিএনপি, জামাআত-জাতীয় পার্টি নির্বিশেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে লেখিকাকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে ম দেওয়া হয়েছে তার চিন্তার জন্য, সম্পর্কের গোপনীয়তা প্রকাশের ভঙ্গির জন্য কিংবা কিছু কথা সোজাসাপটা বলার জন্য। যে কথাগুলো বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এখনো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি- সেই কথাগুলো লেখিকার অত্যন্ত নগ্নভাবে বলেছেন। তসলিমানাসরিন সঠিক না বেঠিক, সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমার হাতে নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশের নারী কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে তসলিমা তালিকার শীর্ষের দিকেই থাকবে। তার বহু বক্তব্যের সাথে দ্বিমত থাকলেও লেখার পরিপক্বতাকে অস্বীকার করতে পারি না। তিনি যা লিখেছেন তা অন্য অনেকেই লিখেছেন। কেউ কেউ আরও বেশিও লিখেছেন। তবে তিনি যেভাবে লিখেছেন অন্যান্যরাসেভাবেলিখেননি। লেখায় অন্যরারাখঢাক করে লিখলেও তসলিমানাসরিন ডামাডোল পিটিয়ে লিখেই বিতর্কিত হয়েছেন।
এটা প্রায় মীমাংসিত যে, তসলিমানাসরিন আমাদের সমাজের যুবক-যুবতিদের জন্য উপকারী নয়। তার লেখার অনেক অংশই সুশৃঙ্খলসমাজব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক। যদি তা না হতো তবে ডানপন্থীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে অতীতের ক্ষমতাসীনবামপন্থিদের সরকার তাকে পুনর্বাসিত করতো কিংবা করার চেষ্টা করতো। সেসব ভাবনা তো দূরের কথা- বিগত দশকজুড়ে তার কয়েকটি বইও বাজারে নিষিদ্ধ পর্যন্ত ছিল। এমনকি তসলিমানাসরিনের ভারতের অবস্থান নিয়ে খোদ ভারতীয় একটি অংশের নাখোশ বারবার মিডিয়ায় এসেছে। বাংলাদেশে তসলিমা বিরোধিতা আরও একটি বড় কারণ রুদ্র মুহাম্মদশহিদুল্লাহ। তাদের ডিভোর্সের পর রুদ্র ভক্তরা তসলিমাকে তাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
বাংলাদেশের কিছু পাঠক তসলিমার লেখা পছন্দ করে। সেটা যতটা না তসলিমা লেখাকে ভালোবাসে তার অধিক তসলিমা নিষিদ্ধ- সেটাকে বিরোধিতা করে। তসলিমানাসরিন কয়েক দশক ভারতে অবস্থান করলেও জনপ্রিয় দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ নিয়মিত তার সাপ্তাহিক কলাম ছাপা হয়েছে। গ্রাম-শহরের লাইব্রেরিতে লেখিকার অনেক বই বিক্রি হচ্ছে। বিগত বই মেলাগুলোতেও বিতর্কিত লেখিকার বই দেদারসে বিক্রি হয়েছে। যেহেতু সামাজিক ট্যাবু আছে তাই তসলিমানাসরিনেরবইয়ের খবর সেভাবে মিডিয়া কভারেজ হয়নি। তবে তার বই বিক্রি কখনোই বন্ধ ছিল না। বরং বহু লেখকের চেয়ে তার বই বেশি বিক্রি হয়েছে।
বইমেলায়তসলিমানাসরিনের বইকে ঘিরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তার দায় কথিত তৌহিদি জনতার চাইতে প্রকাশকেরও একদম কম না। এই অস্থির সময়ে তর্ক করা, বিতর্কিত স্লোগান দেওয়া- এসবে তসলিমা প্রীতি যতটা তার চেয়ে বেশি নজর ছিল একুশের বইমেলায় একটি বিতর্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করা- অন্তত ভিডিও ক্লিপ দেখে এবং প্রকাশিত খবর পড়ে তাই মনে হয়েছে। ব্যক্তি তসলিমাকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশের ডাল-চাল-আলুর কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু তসলিমানাসরিনের চিন্তার প্রসারণ কখনোই বন্ধ থাকে নি। একজন লেখকের স্বাধীন চিন্তায় হস্তক্ষেপ করাও ঠিক নয়। যদি কারো বিরোধিতা করতেই হয় তবে সেটা যুক্তিসংগত পন্থায় হওয়া উচিত। মতবাদের বিকল্পে কেবল মতবাদ সৃষ্টি করেই সেটা মোকাবিলা করা যায়। কথার বিরোধিতায় শক্তি প্রয়োগ করলে সেটা বর্বরতা।
বইমেলায়তসলিমানাসরিনইস্যু মাত্র। সরকারকে বিপদে ফেলার যতগুলো উপায় আছে সেগুলোর সব ধরনের প্রয়োগের চেষ্টা ও চক্রান্ত চলছে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থান ও অবস্থাকে বিতর্কিত করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র চলমান। কাজেই তারুণ্য নির্ভর সরকারের দরকারি পদক্ষেপের ওপর আস্থা রেখে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এক তসলিমানাসরিনের চিন্তা মোকাবিলার জন্য হাজারোচিন্তাবিদতসলিমাকে প্রস্তুত করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিকলড়াইয়ে এটাই সঠিক পদ্ধতি। কাউকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে, কারো বই নিষিদ্ধ করে কিংবা কোন লেখকের স্বাধীন চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে জাতিগতভাবে অগ্রসর হওয়া যায় না। চিন্তার মোকাবিলা চিন্তার মাধ্যমেই করতে হবে। একজন তসলিমানাসরিনকেদমিয়ে রাখা মানে হাজারোতসলিমার জন্মকে উৎসাহিত করা।
রাজুআহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com