১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম।
ভৌগলিক অবস্থান, উন্নয়নশীল অর্থনীতি, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং দুর্যোগ-প্রবণ আবহাওয়ার জন্য
বাংলাদেশের জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি অনেক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ
প্রতিবছর বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড়
উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নভূমি তলিয়ে যাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে, বাংলাদেশের গড়
তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে যা উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায়
১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলবে। তবে উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ
গলতে থাকায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্রাণঘাতী দুর্যোগ ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা,
জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততাকে প্রধান
প্রাকৃতিক বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
জলবায়ু পরিবর্তন কে ত্বরান্বিত করা ও দ্রুত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পেছনে ঐতিহাসিকভাবেই শিল্পোন্নত
দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ দায়ী। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো, যাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ভীষণ নগণ্য,
অথচ শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নির্গমনের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এই দেশগুলোই। জলবায়ু
পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের নির্গমনের একটি ভগ্নাংশের অবদান রেখেছে
উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমান বৈশ্বিক হিসাবে অত্যন্ত নগণ্য,
শতকরা ১ ভাগের থেকেও ক্ষুদ্র। বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ – ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও
সরকার প্রধানসহ প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী, নাগরিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সাংবাদিকরা মিলিত
হয়েছে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে (কপ–২৬)। এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশও
আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ ৫৫ টি দেশ নিয়ে গঠিত জলবায়ু বিষয়ক উচ্চ
পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। এই ৫৫টি দেশগুলো মধ্যে যারা
বিশ্বের ১ শতাংশের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, সেই দেশগুলোই নিঃসরণজনিত কারণে সৃষ্ট
জলবায়ু সংকটের ক্ষতির শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মুখপাত্র
হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার বিষয়টি বাংলাদেশের আলোকে উত্থাপনের জন্য, পরিবেশ
বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পলিসি অ্যান্ড
গভর্নেন্স (এসআইপিজি)-এর সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) যৌথভাবে “বাংলাদেশে জলবায়ু ন্যায়বিচার”
শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। সেমিনারটি ২২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির
সিন্ডিকেট হলে বিকাল ৩.০০ টায় শুরু হয়।
সেমিনারে জনাব আবুল কালাম আজাদ, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) প্রেসিডেন্সির বিশেষ দূত,
বাংলাদেশ সরকার, ইউএনডিপি জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ জনাব এ.কে.এম মামুনুর রশিদ, এবং জনাব মুকিদ
মজুমদার বাবু, চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এর মত বিশিষ্ট বক্তা এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা
একত্র হয়েছেন।
মূল বক্তা, প্রফেসর মোঃ জাকারিয়া, পিএইচডি, তার বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা যে অসম বিশ্বে বাস করি সেখানে
জলবায়ু ন্যায়বিচারের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং বাংলাদেশের জলবায়ু অভিবাসীদের সংজ্ঞায়িত করা, জলবায়ু
সমাধান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, জলবায়ুর আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তুলে ধরেছেন।
ন্যায়বিচার, এবং জৈব বৈচিত্র্য-প্ররোচিত কৌশল গ্রহণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য
জলবায়ু আক্রান্তদের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য আওয়াজ তুলেছেন।
সেমিনারে উপস্থিত প্রধান অতিথি জনাব আবুল কালাম আজাদ তার বক্তব্যের মাধ্যমে জানান যে জলবায়ু
পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশুর ওপরে এবং তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্লাইমেট সলুশ্যন সেন্টার স্থাপনের ইচ্ছা কে সাধুবাদ জানান। তিনি আরো বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু
বিষয়ক ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আওয়াজ তুলেছি, তুলছি এবং তুলে যেতেই থাকবো” ।
আলোচনাকারীদের মধ্যে ড. নুরুল কাদির, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ সরকার এবং বিকল্প সদস্য
সিডিএম নির্বাহী বোর্ড, ইউএনএফসিসি তার বক্তব্যে বলেন “উন্নয়ন আমাদের অধিকার, শিল্পোন্নত রাষ্ট্র
তাদের কার্বন নিঃসরণের দায় উন্নয়নশীল দেশের উপর চাপিয়ে দিয়ে, এই দেশগুলোর উন্নয়ন রোধ করার অধিকার
রাখে না। নতুন প্রজন্মকে প্রয়োজনে মাঠে নেমে নিজেদের অধিকার এবং জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা
নিশ্চিত করেত হবে” ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (এএসকে) নির্বাহী পরিচালক জনাব গোলাম মনোয়ার কামাল এবং রাষ্ট্রদূত শহীদুল
হক, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ সরকারের এবং প্রফেসরিয়াল ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ সাউথ
ইউনিভার্সিটি এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জলবায়ু অধিকার এবং ন্যায়বিচার জলবায়ু সমস্যা এবং বর্তমান
ঘটনায় ন্যায়বিচারের তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করা হয়। জনাব শহীদুল হক বলেন, “জলবায়ু সমস্যার
সমাধান শুধুমাত্র জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই টেঁকসই ভাবে সমাধান করা সম্ভব” । জনাব
মনোয়ার কামাল ও তার বক্তব্যে জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জোর দাবী জানান এবং উক্ত
বিষয়টি শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নয়, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন।
ইউএনডিপি জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ জনাব এ.কে.এম মামুনুর রশিদ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ন্যায়বিচারের
সম্পর্ক তুলে ধরেন ও ব্যাখ্যা করেন যে উন্নত রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী ও অকার্যকর প্রতিশ্রুতিতে ভরসা না
রেখে নিজেদের সমস্যা নিজেদের মোকাবিলার প্রতি জোরদার করা উচিত।
উক্ত সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ওয়াতার এইড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর জনাবা হাসিন
জাহান, তিনি জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপাত্ত ও গবেষণার উপর জোর দিতে নির্দেশ
দেন, যাতে করে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আরো উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদি সহ জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের দায় ও
ক্ষতিগ্রস্থ দেশের ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব দেওয়া যায়। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, জলবায়ু সমস্যার অন্যতম
সমস্যা হচ্ছে নিরাপদ পানির সমস্যা।
এই সেমিনারের মাধ্যমে, তাদের লক্ষ্য প্রমাণ-ভিত্তিক গবেষণা তৈরি করা যা দেশকে জলবায়ু ন্যায়বিচার,
সরঞ্জাম এবং কৌশলগুলির উদীয়মান উকিলদের সাথে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে যা তরুণ/গবেষকরা
বিশ্বব্যাপী অনুসরণ করতে পারে এবং একটি নতুন প্রজন্মের গবেষণা উদ্যোগ তৈরি করতে পারে যা সরাসরি ৮ম
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি, এবং ভিশন ২০৪১ এর পরিপূরক।