নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এর সেভেনটি থার্ড স্ট্রিটের নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ স্ট্রিট। এবারের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে এই নামকরণ করা হয়েছে। এদিন বাঙালিরা ছিল ভীষণ উল্লসিত! নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিল তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এর আগে নিউ ইয়র্কের দুটি এলাকা ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ নামকরণ করা হয়েছে। এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নাম আমাদের দেশের নামে হলো। এটা নিঃসন্দেহে বেশ বড় ঘটনা! আনন্দিত হবার মতো ঘটনা! যারা এ কাজটি করেছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানাই।
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি প্রচুর। জ্যাকসন হাইটসে গেলে মনে হয়, দেশেই আছি। এটা বাংলাদেশিদের প্রাণকেন্দ্র। দেশি খাবারের রেস্টুুরেন্ট, মাছ মাংস, মশলা, শাড়ির দোকান ভুরি ভুরি। ইলিশের গন্ধ, তাজা কই-এর লাফালাফিতে দেশি মৌতাত আসে। দু’পা যেতে না যেতেই শোনা যায় বাংলা কথা। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের ভাষা। সন্ধ্যার পর রাস্তায় টেবিল পেতে বাংলাদেশিরা আড্ডা দিচ্ছে এমনটাও দেখেছি।
বাংলাদেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার দূতাবাস ছিল না বাংলাদেশে। এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থনের পর অর্জেন্টিনা বাংলাদেশে তাদের অ্যাম্বাসি খুলেছে। এটাও একটা বড় ঘটনা।
পাশের দেশ ভারতে ছড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অজস্র স্মৃতি। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ‘স্বাধীনবাংলা দেশ সরকার’-এর অফিসসহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ করা হবে বলে জেনেছি। এটাও আনন্দের খবর! আগরতলাতেও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি। সেগুলোও সংরক্ষণ হওয়া দরকার।
কোন কিছু অর্জন করতে পারলে ভাল লাগে, আনন্দ হয়। আমাদের ছেলে মেয়েরা ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাল রেজাল্ট করছে, সম্মানজনক চাকরি করছে এটা আমাদের গৌরব। আমেরিকার প্রশাসন, নিরাপত্তা , পরিবহন, রেস্তোরা কৃষি খাতে অবদান রাখছে বাংলাদেশিরা। আইটি সেক্টরে ভারতীয় ও চাইনিজদের পরেই বাংলাদেশিদের অবস্থান।
চিকিৎসক, গ্রাফিক্স, ডিজাইনার, ডেভলপিং-এ বাংলাদেশিরা সুনামের সাথে কাজ করছে। ওসব দেশে তো আর ঘুষ সিস্টেম চালু নেই। যে ভাল করে, যে যোগ্য তারই উন্নতি হয়। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে অনেকগুলো বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। প্রতি বছর আমেরিকার নিউ ইয়র্কে বইমেলার আয়োজন করা হয়। কয়েক বছর ধরে আমেরিকার বেশ কয়েকটি স্টেটসহ ইউরোপ ও কানাডাতেও বইমেলার আয়োজন হচ্ছে। বাংলাদেশের লেখক প্রকাশরা মেলায় অংশ নিচ্ছেন। বাংলা বইয়ের প্রচার হচ্ছে। আমাদের সম্মান বাড়ছে।
আমাদের শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। দেশের সমৃদ্ধিতে আবদান রাখছে। এমনকি যে মেয়েগুলো বাসাবাড়িতে কাজ করত তারাও এখন দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। ফলে তাদের হাতে টাকা এসেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছে তারা। যদিও সাথে নিরাপত্তাহীনতাও আছে।
এই যে আমাদের অর্জন, স্বীকৃতি এগুলোর মর্যাদা আছে। পেলাম আর হেলায় হারালাম সেটা কিন্তু ঠিক না। বাইরে যারা আছেন তাদের চালচলন আচার আচরণ যেন হয় মার্জিত, শোভন। তারা যেখানে, যে কাজই করেন তা যেন করেন দায়িত্বশীলতার সাথে। বিদেশে কোন কাজকেই ছোট চোখে দেখা হয় না। যারা ব্যবসা করছেন তারা যেন অতি লোভ বা অতি মুনাফার লোভে এমন কিছু না করেন যাতে দেশ নিন্দিত হয়। প্রবাসীর পরিচয় ব্যক্তিতে না, দেশে। যারা চাকরি করছেন তারা যেন তার সর্বোচ্চ এফোর্ট দেন। যেন যে দেশে থাকেন সে দেশের নিয়ম কানুন মেনে চলেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
বিদেশে অনেক শক্ত শক্ত নিয়ম কানুন আছে। ইচ্ছেমতো চিৎকার চেঁচামিচি ঝগড়া করা যায় না। সন্তানের গায়ে হাত দেয়া যায় না। এমন কি তাকে যা ইচ্ছা তা খাওয়ানোও যায় না। পশ্চিমের প্রায় প্রতিটি দেশে সোস্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম আছে । তারা বাচ্চাদের ব্যাপারে ভীষণ সেনসেটিভ।
শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্য, কিছু বাংলাদেশির স্বভাব কথায় কথায় দল পাকানো। ইউরোপ আমেরিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির একাধিক দল আছে। তাদের মধ্যে গ্রুপিং আছে। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে মারামারি হবার খবর আমরা পাই। পদ পদবী নিয়ে দলাদলি, নোংরা ছোড়াছুড়িও আছে। এসব বিষয় পরিহার করা দরকার।
বেসরকারি পর্যায়ে তো বটেই সরকারি পর্যায়েও একাধিক নারী কেলেংকারির ঘটনা আমরা শুনেছি। এসব আমরা শুনতে চাই না।
বিদেশে গেলে মানুষ ভীষণ রকম দেশমুখী হয়ে পড়ে। দেশে থাকতে তারা নিজের দেশকে যতটা ভালবাসে বিদেশে গিয়ে বাসে তার চেয়ে অনেক বেশি। তিন পুরুষ বিদেশে আছে তারপরও তারা কিন্তু দেশ বলতে বাংলাদেশকেই বোঝে। দেশের প্রতিটি খবর তাদের আন্দোলিত করে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে যোগাযোগ অতি সহজ হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিনের প্রতিটি খুঁটিনাটি তারা জানতে পারে। তাই দেশে দুই দলে মারামারি হলে বিদেশে থাকা সমর্থকদের মধ্যেও তার জের পড়ে।
আমরা একটা ভূগোলে বড় হয়েছি। আমাদের রুচি সংস্কৃতি জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিকতা সবই আলাদা। বিদেশে থাকলেও আমরা তাই সম্পূর্ণ বিদেশি হয়ে যেতে পারি না। অবস্থা হয় অনেকটা না ঘরকা না ঘাটকার মতো। তাই শিশু জন্মাবার পর থেকেই বাবা মাকে ভাবতে হবে, তাকে কীভাবে বড় করবেন। বিদেশিদের মতো করে, নাকি দেশের মতো করে। বিদেশিদের মতো করে মানুষ করতে হলে আগে তো নিজেদের বিদেশিদের মতো হতে হবে। সেটা কঠিন কাজ।
বিদেশে সবচেয়ে বড় বাধা ভাষা। তাই বাইরে যাবার আগে ইংরেজি ভাষাটা ভাল করে রপ্ত করা দরকার। যারা তা না করেই চলে গেছেন তারা মুশকিলে পড়েছেন প্রথম দিকে। কাজ করতে করতে নিশ্চয়ই তারা শিখে যান বা অন্তত চালিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু অনেক খাবি খাবার পর।
বাংলাদেশের কতিপয় লোকের সুনাম নেই। প্রায়ই সুইচব্যাংকে টাকা থাকার কথা শোনা যায়। কানাডায় একটা বেগম পাড়া আছে। সেটা নাকি অনেক বাংলাদেশির সেকেন্ড হোম। বিলাসবহুল বাড়ি, সুইমিংপুল, কোটি কোটি টাকার ব্যাপার স্যাপার। বেগম পাড়া নামটা উচ্চারিত হয় খানিকটা ঘৃণার সাথে। এটা আমাদের কাম্য না। দেশকে ফকির করে দিয়ে বিদেশে এই জাতীয় বিলাসী জীবনযাপন নিন্দনীয়। বিদেশে বাঙালির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে তার শিক্ষা দিয়ে, আচরণ দিয়ে, রুচি দিয়ে, সংস্কৃতি দিয়ে।
আমেরিকায় গিয়ে বিত্তবান লোক দরিদ্র কোটায় চিকিৎসা নিয়েছেন, একজন হাসপাতালের বিল না মিটিয়ে চলে এসেছেন এমনটাও শোনা যায়। কতটা সত্য কতটা মিথ্যা জানি না। কিন্তু এ জাতীয় কথা ওঠা দেশের অপমান!
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটা বড়ই গর্বের বিষয়। দেশগুলো তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষাকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করলেও তারিখটা ২১ ফেব্রুয়ারি। যারা অনুসন্ধানী, যারা জানতে চায় কেন এই দিনটিকে বেছে নেয়া হলো, তারা জেনে যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নামে দক্ষিণ গোলার্ধের একটা দেশের বীর সন্তানরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।
আমরা বাংলাদেশ স্ট্রিট তো পেলাম। কিন্তু এই স্ট্রিটের মর্যাদা যেন আমরা রাখতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে, নামটা ‘বাংলাদেশ স্ট্রিট’। বাংলাদেশ কোন রাস্তার নাম না, একটা দেশের নাম। যে দেশের আছে সমৃদ্ধ অতীত। আছে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯- এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ। আছেন তিরিশ লক্ষ শহিদ, ২ লক্ষ নির্যাতিত মা বোন, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা। আছেন ভাষা সংগ্রামীরা, জাতীয় চার নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দেশটাকে স্মরণ করে এই নামটি রাখা হয়েছে। প্রবাসী ভাইবোনদের প্রতি আমার অনুরোধ, এমনভাবে চলুন, এমন কাজ করুন যাতে ঐ রাস্তা দিয়ে যারা চলবে সবাই যেন বাংলাদেশকে স্মরণ করে, দেশটিকে জানতে চায়।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক