রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: ফলন ভাল হলেও আলু উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা রংপুরে কৃষকের মুখে হাসি নেই। বাজারে দাম না থাকায় আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছে চাষিগণ। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বড় বড় পাইকার না আসায় অনেক চাষি কম দামে আলু বিক্রয় করছে। এতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এখন পর্যন্ত ৭০ ভাগ জমির আলু উত্তোলন করা হয়েছে। বছরে দেশে আলুর চাহিদা থাকে ৮০ লক্ষ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশীয় চাহিদার অতিরিক্ত আলু আধুনিকায়ন পদ্ধতিতে রপ্তানিযোগ্য করতে পারলে রপ্তানি বেড়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হতো। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলু চাষিরা কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। তবে পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলসহ মিঠাপুকুর, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ এবং সদর উপজেলার অধিকাংশ উঁচু জমিতে আগাম জাতের আলু চাষ করা হয়। এ সব জমিতে আলুর ফলন বা¤পার হলেও বাজারে দাম না থাকায় কৃষককের মুখে হাসি নেই। প্রথম দিকে আগাম জাতের আলু প্রতি বস্তা (৮৮ কেজি) দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রয় করা হলেও গত তিন সপ্তাহ থেকে বাজারে ধস নেমেছে। বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা লাল জাতের আলু ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা, সাদা জাতের আলু ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রয় করা হচ্ছে। প্রতি কেজি পাইকারি দরে পড়ে ৯ টাকা থেকে ১০ টাকা করে। এসব আলুতে উৎপাদন খরচ হয়েছে কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা করে। এক কষক বলেন, কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের অভিরাম এলাকার আলু চাষি মমতাজ আলী বলেন, ধার দেনা করে দেড় একর জমি লিজ নিয়ে আলু চাষ করেছি। দিনরাত পরিশ্রম করে তোলার পর এখন বাজারে দাম নেই। সার কীটনাশকের দোকানের বাকি টাকা পরিশোধ করতে একটা চাপ থাকে সাধারণ কৃষকদের। আলু বিক্রয় করতে তিন দিন ধরে পাইকার খুঁজছি। পাইকার পাচ্ছি না। কি করব বুঝতে পারছি না। আলু চাষ করে এবার মাঠে মারা যাচ্ছি। কারণ উৎপাদন খরচ উঠছে না। তার উপর আরেক শঙ্কা বাকিতে আলু বিক্রয় করা। পীরগাছা বাজারের আলু ব্যবসায়ী মন্তাজ উদ্দিন বলেন, চাষিরা আলুতে লাভ করবে এটা এখন লটারির মতো হয়ে গেছে। ৪-৫ বছরে একবার ভালো দাম পায়, আর বাকি বছরগুলো লাভের আশায় লোকসানে পড়ে আলু চাষিরা। এবার দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলার বড় বড় ব্যবসায়ীরা আলু ক্রয় করতে আসেনি। দুই একজন এসেছে, তাদেরও চাহিদা অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম। ১০ টাকা কেজির উপরে কোনো বড় পার্টি দাম করছেন না। তার উপর দাম পরিশোধে সপ্তাহ খানেক অপেক্ষার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে তারা। ছোট ব্যবসায়ীরাও সাহস পাচ্ছি না এই শর্তে আলু ক্রয় করতে। কৃষক সংগ্রাম পরিষদ রংপুর জেলা আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, প্রতি বছর চাষিরা লোকসানে পড়ছে। বিশেষ করে যারা লিজ নিয়ে আলু চাষ করে তারা। লোকসান ঠেকাতে হাটে বাজারে ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে সরকারিভাবে আলু ক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে কৃষকরা উৎপাদন খরচের উপর ৩৩ শতাংশ সহায়তা পেয়ে বিক্রয় করতে পারে। এছাড়াও কোল্ড স্টোরগুলোতে আলুর সংরক্ষণের জন্য ভাড়া কমানো হলে কম মূল্যে বিক্রয় না করে কৃষকরা দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে পারবে। পরবর্তীতে সংরক্ষিত এই আলোগুলো ন্যায্যমূল্যে কৃষকরা বিক্রি করতে পারবে। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলায় ৯৭ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ করা হয়েছে। এখন জমি থেকে আলু উত্তোলন পুরোদমে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রংপুর জেলায় ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যা গতবারের চাষ করা হয়েছে তুলনায় এবার প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর বেশি। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান বলেন, এবার রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা আশা করা হচ্ছে। আলু ন্যূন্যতম ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রয় করতে না পারলে কৃষকরা লোকসানে পড়বে। পরবর্তীতে আলু চাষ থেকে বিমুখ হবে।