অস্ট্রেলিয়া, ১১ ডিসেম্বর, ২০২১
১১ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসের সূবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেকুলার বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া চ্যাপ্টার কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ার বিডি হাব, ২ এরিকা লেন-এ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
ফোরাম ফর সেকুলার বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া চ্যাপ্টারের সভাপতি ডাঃ একরাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধান অতিথি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হক এবং প্রধান বক্তা হিসাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয় অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময়।
ফোরাম ফর সেকুলার বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া চ্যাপ্টারের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হারুণ উর রশীদ, নির্মূল কমিটি অস্ট্রেলিয়া শাখার সহসভাপতি সাজ্জাদ সিদ্দিকী, নির্মূল কমিটি অস্ট্রেলিয়া শাখার সহসভাপতি হাসান শিমুল ফারুক রবীন, নির্মূল কমিটি অস্ট্রেলিয়া শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক কাজী আশফাক রহমান ও নির্মূল কমিটি অস্ট্রেলিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল তালুকদার।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হক বলেন, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাঙালি জাতির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সহ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ২ লক্ষ বীরঙ্গনাসহ মহান মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বাংলার জনসাধারণকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা ১৫ই আগস্ট একজন ব্যক্তিকে শুধু হত্যা করতে চায়নি, তারা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে হত্যা করতে চেয়েছে। বাস্তবে তারা কিছুটা সফলও হয়েছিল; কারণ পরের ২১ বছর জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পূর্ববর্তী অবস্থায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। জিয়া থেকে খালেদা জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিতাড়ন করেছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই রাজনীতিকে আবার ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজটি অত্যন্ত সুচতুরভাবে করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া। তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি পঁচাত্তরের ঘাতকদের সাংবিধানিকভাবে হত্যার দায়মুক্তি দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে পদায়ন করেছিলেন।
তিনি আরো বলেন, ‘এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজন করে তা আরো এক ধাপ ওপরে নিয়ে গিয়েছিলেন। খুনি কর্নেল ফারুককে দেশে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া একাত্তরের ঘাতকদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানীকরণের ষোলোকলা পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় পঁচাত্তরের ঘাতক কর্নেল রশিদ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী তামাশার বদৌলতে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন।বাংলাদেশকে জিয়া-এরশাদ-খালেদার পাকিস্তানীকরণ কর্মসূচিতে ছন্দঃপতন ঘটে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার গঠনের মাধ্যমে। বর্তমানে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে এক ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করেছেন। নিজে পরিচিত হয়েছেন একজন বিশ্বসেরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। কিন্তু তাঁর সামনে শুধু একটা মসৃণ পথ, তা ভাবলে ভুল হবে। একজন তারেক রহমান পলাতক, আর কয়জন কারাগারে, মোশতাকের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে, তা ভেবে সব কিছু নিরাপদ ভাবলে মারাত্মক ভুল হবে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে অনলাইন ও অফলাইনে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বিশেষভাবে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অতুলনীয় বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে নির্মূল কমিটি করোনা মহামারীর সীমাবদ্ধতার ভেতরও বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম অনলাইন আলোচনা। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আমাদের পরম সুহৃদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি এবং আমরা অস্ট্রেলিয়া না গিয়েও এই সিডনীর এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারছি, তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিশেষভাবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ৫০ বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে, যা বহু দেশের জন্য অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতার জন্য আমরা যে মূল্য দিয়েছি বিশ্বের অন্য জাতিকে তা দিতে হয়নি। এ জন্য স্বাধীনতা আমাদের কাছে এত মূল্যবান।
‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলাম গংদের ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার পাশাপাশি ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, নির্যাতন, বৈষম্য বন্ধ করার জন্য। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানপন্থী ঘাতকরা ক্ষমতায় এসে আবার পাকিস্তানের মতো ধর্মের নামে রাজনীতির পুনর্জন্ম দিয়েছে, যা আজও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা যে সংবিধান বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিয়েছিলেন তার মর্যাদা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে শপথ নিতে হবেÑ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংবিধানে পুনপ্রবর্তন এবং ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য আমরা আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখবো।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী সরকারগুলো ঘাতক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত এবং পুরস্কৃত করেছে। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়েছে, জামাতের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করেছে, নিজামী ও মুজাহিদদের মন্ত্রী বানিয়েছে। এখানেই তারা থেমে ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা দেশে এবং বিদেশে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে, এমনকি বিচার বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির লক্ষ্যে লবিস্ট পর্যন্ত নিয়োগ করেছে। এমনি এক ক্রান্তিকালে ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধী নরঘাতকদের বিচারের দাবিতে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আজ অব্দি তাঁদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘রমনার বটমূলে উদীচীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে এ যাবতকাল পযন্ত বাংলাদেশে সংগঠিত সকল জঙ্গি হামলাগুলো শুধুমাত্র অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর উপর করা হয়েছে যেখানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যতদিন না হবেÑ ততদিন এই ধরণের হামলা চোটে থাকবে বলে সবাইকে সতর্ক করেন।’
অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হারুণ উর রশীদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী সংগঠন জামাত শিবির ও তাদের দোসর বিএনপি তাদের শাসন আমলে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং জঙ্গি নেটওয়ার্ক স্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে।’