শহীদুল ইসলাম শরীফ, স্টাফ রিপোর্টার
অধিকাংশ লোক সিগারেটের কুফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অনেকে এমনও আছেন, যাঁরা ধূমপান মন থেকে ছাড়তে চান। তবু পেরে ওঠেন না। অফিসে কোনও রকম সমস্যা হলেই নিচে গিয়ে একটা সিগারেটে টান না দিলে নাকি উদ্বেগ কমে না। কর্মক্ষেত্রে চাপ, সাংসারিক টানাপড়েনের কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ক্রমাগত বেড়ে চলছে জীবনে।
সিগারেটের সহজলভ্যতা ধূমপান বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। ধূমপান জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য এতোটাই সহজলভ্য যে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে জন ‘হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’ কর্তৃক ঢাকার ১১০টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ওপর পরিচালিত গবেষণায় বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে ৫৯১টি তামাক পণ্যের খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে। এটা ছিল পাঁচ বছর আগের খবর। বর্তমানে এ সংখ্যাটা বাড়ছে বই কমছে না। এছাড়া অলিতে গলিতে থাকা প্রায় প্রতিটা দোকানে তামাক জাতীয় পণ্য পাওয়া যায়। ব্যাপারটা এমন যে, যে দোকানে সিগারেট থাকে না সে দোকানে বেশি বিক্রি হয় না। সুতরাং দোকানের বিক্রি বাড়ানোর জন্যে হলেও দোকানদাররা তামাক জাতীয় দ্রব্য বিক্রি করেন।
শিশু-কিশোরদের ধূমপানে আসক্ত হওয়ার অন্যতম মারাত্মক একটি কারণ হলো তাদের বাহক বানানো। আমাদের সমাজে বাহকের চিত্রটি খুব সাধারণ। ছোটদের হাতে বড়রা টাকা দিয়ে বলে, ‘এই যা সিগারেট নিয়ে আয়’। অথচ ভেবে দেখি না নিয়মিত সিগারেট বহন করার ফলে এটি তাদের উপর কি রকম প্রভাব ফেলে। ছোটদের যেকোনো বিষয়ে কৌতূহল বেশি। তারা “কি, কেন, কীভাবে’ এই সবের উত্তর খুঁজে ফিরে। সিগারেটের ক্ষেত্রেও সেটার ব্যতিক্রম নয়। একটা ছেলে যদি নিয়মিত তার বাবা, ভাই, চাচা, প্রতিবেশীর জন্য সিগারেট বহন করে তখন এটার প্রতি তার কৌতূহল বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ফলে দেখা যায়, একদিন সাহস করে একটা সিগারেট কিনে নিজেই তার কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করে। একদিন সেই চেষ্টাই অভ্যাসে পরিণত হয়। অভ্যাসের দাস হয়ে সে মারাত্মক ভাবে সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন ভাবে টাকা জমিয়ে দোকান থেকে সিগারেট কিনে।
ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট ‘(ভ্যাপিং ডিভাইস’ বা ‘ভ্যাপ পেন)’ কে প্রচলিত তামাক তথা নিকোটিনে ভরপুর সিগারেটের একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি একটি ব্যাটারিচালিত ডিভাইস যা সিগারেটের চাহিদা পূরণ করে থাকে। কয়েক বছর আগে যখন বাজারে এই ই-সিগারেটের প্রচলন শুরু হয় তখন একে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের ধূমপানের অভ্যাস দূর করার জন্য একটি কার্যকরী প্রযুক্তি হিসেবেই ধরা হয়।
তবে যে-রকম ভাবা হয়েছিল সেরকম আসলে ঘটল না। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে সিগারেট বাজারের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয় নবাগত ই-সিগারেট। গতানুগতিক সিগারেটের চেয়ে এই নতুন ধরনের সিগারেটের চাহিদাই জনগণের কাছে বাড়তে থাকে। পরিকল্পনানুসারে এর মূল ক্রেতা প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের হওয়ার কথা থাকলেও তা হলো না। উল্টো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর -কিশোরীরা, যারা কখনো ধূমপানই করেনি, তারা এই সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আসলে ই-সিগারেট বিভিন্ন আকার এবং স্বাদ ও গন্ধের পাওয়া যাওয়ায় তা সকলের নিকট অধিক সমাদৃত হয়। তবে এর কুফল যে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয় সেই ব্যাপারটা অনেকেই অগ্রাহ্য করে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এই ই-সিগারেটের ফলে ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে এবং ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ ফুসফুসের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়।
গবেষকদের মতে, নিকোটিনের সাথে চিনি বা মিষ্টি জাতীয় উপাদানের সংযোগ এই ধরনের সিগারেটের প্রতি আসক্তিকে বেশি দৃঢ় করে। এটা এই প্রোডাক্টের আসক্তি-সৃষ্টিকারী একটি বিশেষ গুণ। টিউবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার নীলস ক্রোমার এরকম তথ্য দেন। হঠাৎ করে ই-সিগারেটের চাহিদা বাড়ার পেছনে বিভিন্ন ফ্লেভার বা স্বাদের হওয়া যেমন একটি বড় কারণ, তেমন মিষ্টির সংযোগে আরো বেশি নেশা-সৃষ্টিকারী দ্রব্য তৈরি করা সুদূর ভবিষ্যতে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী।
আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের আইএআরসির (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার) গবেষকদের মতে, যারা তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি যেমন জর্দা দিয়ে পান খান, তাদের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় মুখের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। অনেকের ধারণা, ধোঁয়াযুক্ত নেশাদ্রব্যই শরীরের জন্যে ক্ষতিকারক, অন্য কোনোকিছু অতটা ক্ষতি করে না। প্রকৃতপক্ষে, জর্দা স্লো পয়জনিং করে। ক্ষতিটা হয় আস্তে আস্তে। কিন্তু পরিণতি ভয়াবহ।
যারা তামাক বা সিগারেটে আসক্ত। তাদের সাথে ঐসহ নেশা জাতীয় দ্রব্যাদির প্রেমের সম্পর্ক,ভালোবাসার সম্পর্ক। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কঠিন মনোবলে হঠাৎ করেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
কাজের সুবাদে দুজন জাপানিজ এর সাথে আলাপ হয়, দুজনই ছিলেন সিগারেটে আসক্তি, তারা প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ শলাকা সিগারের পান করতেন। দীর্ঘ ২৫ বছর সিগারেটে আসক্ত ছিলেন, প্রায় ১০ বছর আগে হঠাৎ সিদ্ধান্তে সিগারেট পরিত্যাগ করেন।
সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষিতে স্লোগান সহ মিছিলের সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, তবে ১০০ লোকই মনে করে এটা ফান বা কমেডি।