ভারতের আদানি গ্রুপের ব্যাপক ‘শেয়ার কারচুপি’ নিয়ে মার্কিন পরামর্শক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না এটির শেয়ারমূল্যের পতন। অব্যাহত পতনের কারণে গ্রুপটি মাত্র ৮ দিনে ১০ হাজার কোটি ডলার খুইয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পরিস্থিতির নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না ঘটলে সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের অন্যতম ও এশিয়ার সাবেক শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের লোকসান আরো বাড়বে।
গত ২৪ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ভারতের শেয়ারবাজারের ওপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে আদানি গ্রুপ শেয়ার বাজারে জালিয়াতি করে যাচ্ছে।
হিন্ডেনবার্গের দাবি, আদানি গ্রুপ ভুল তথ্য ও রাজনৈতিক সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করছে এবং এর মাধ্যমেই আদানি গ্রুপ বাজারে নিজেদের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে।
জাল-জালিয়াতি ও কারসাজির আশ্রয় নিয়ে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অভিযোগও তারা করেছে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে।
ফ্রান্সের সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি টোটাল এনার্জিস এবং আমিরাতভিত্তিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আবুধাবি’স ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির সঙ্গে সম্প্রতি চুক্তি করেছে আদানি গ্রুপ।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়ে, সেই চুক্তিপত্রেও নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে ‘অতিরঞ্জিত’ তথ্য দিয়েছে গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান।
ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ঝরে পড়া গৌতম আদানি গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের শীর্ষ ধনী শিল্পপতিদের একজন। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা এবং ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া থাকায় দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিও তিনি।
এই রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই গত কয়েক বছরে রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল আদানি গ্রুপ এবং ৬০ বছর বয়সী গৌতম আদানি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী।
তবে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে সে সবই এখন বিগত দিনের সোনালী ইতিহাস গৌতম আদানি ও তার মালিকানাধীন আদানি গ্রুপের জন্য। কারণ শেয়ার বাজার বিশ্লেষণকারী বিভিন্ন সংস্থার বরাতে জানা গেছে, গড় হিসেবে গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ারের দাম গত আট দিনে কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। অনেক বিনিয়োগকারীও আদানি গ্রুপ থেকে তাদের অর্থ উঠিয়ে নিচ্ছেন এবং এসব কারণেই আদানি গ্রুপের আর্থিক লোকসান ছুঁয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক।
গৌতম আদানিও এখন আর শীর্ষ ধনীর তালিকায় নেই। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় বর্তমানে ১৭ তম অবস্থানে আছেন আদানি।
আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে অবশ্য এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন ‘মিথ্যা’, ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘শত্রুতাপূর্ণ’। আরো বলা হয়েছে, ভারতের শেয়ারবাজার সম্পর্কে ‘কোনো ধারণা নেই’ হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের। এমনকি এই প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ভারত, তার স্বাধীনতা ও সংহতিকে ‘আক্রমণ’ করেছে—অভিযোগ করে আদানি গ্রুপ বলেছে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের বিরুদ্ধ আইনী ব্যবস্থা নেবে তারা।
বিবৃতির পাল্টা জবাবে দিয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চও। সংস্থাটি বলেছে,‘মূল বিষয়গুলো থেকে নজর ঘোরাতেই ওই গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। নিজের ও সংস্থার মাত্রাছাড়া শ্রীবৃদ্ধিকে দেশের উত্থানের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছে।আমরা বিশ্বাস করি, জালিয়াতি জালিয়াতিই।’
‘আমরা আরো বিশ্বাস করি, ভারতের ভবিষ্যতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আদানি গোষ্ঠী। ভারতীয় পতাকায় শরীর ঢেকে তারা দেশকে লুট করে চলেছে।’
এদিকে কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে কমতে থাকায় নতুন শেয়ার ছাড়ার ঘোষণা দিয়েও তা স্থগিত করেছেন গৌতম আদানি।
ভারতের মুম্বাইভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষক অবিনাশ গোরক্ষকর বলেন, ‘মূল সমস্যা হলো— বিনিয়োগকারীরা আদানি গ্রুপের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। গৌতম আদানি যদি শিগগিরই অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে তাদের পতন অব্যাহত থাকবে।’