প্রেস বিজ্ঞপ্তি
মানবপাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ৫ জন সক্রিয় সদস্যকে চট্টগ্রাাম ও
কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার এবং বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ
অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভুয়া নথিপত্র জব্দ করেছে র্যাব-৭, চট্টগ্রাম।
১। র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের বিভিন্ন অপরাধ এর উৎস উদ্ঘাটন, অপরাধীদের
গ্রেফতারসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। র্যাব-৭,
চট্টগ্রাম অস্ত্রধারী সস্ত্রাসী, ডাকাত, ধর্ষক, র্দুর্ধষ চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি,
ছিনতাইকারী, অপহরণকারী ও প্রতারকদের গ্রেফতার এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র, গোলাবাদ ও
মাদক উদ্ধারের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করায় সাধারণ জনগনের মনে আস্থা ও বিশ্বাস
অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
২। এই মানব পাচার চক্রের মূলহোতা ধৃত ১ ও ২নং আসামী ইসমাইল হোসেন ও শফিউল আলম।
এরা পরষ্পর সহোদর ভাই। তাদের উভয়ের নামে বিভিন্ন থানায় ০৭টি করে মানব পাচার আইনে মামলা
আছে। তারা কক্সবাজার জেলার পেকুয়া ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানা এলাকার নিরীহ মানুষের
দারিদ্রতার সুযোগে স্বল্প খরচে বিদেশ পাঠানোর জন্য কন্ট্রাক করে তাদের নিকট থেকে খালি
স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে কিছু টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের পাসপোর্ট
বানানোর জন্য তাদের অন্যতম সহযোগী আসামী রিয়াজ খাঁন রাজুকে দেয়। আসামী রিয়াজ খাঁন
রাজু মালোশিয়া যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের পাসপোর্ট তৈরীর কাজ সম্পন্ন করে স্ব-স্ব ব্যক্তিদের
নামে প্রস্তুতকৃত পাসপোর্ট প্রদান করে তাদের মনে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বলে তাদের মাধ্যমে
স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়া সম্ভব। নিরীহ লোকজন এই চক্রকে বিশ্বাস করে রাজুর নিকট মোট
খরচের অর্ধেক টাকা জমা করতো। অতঃপর রাজুর সহযোগী উল্লেখিত অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায়
মালয়েশিয়া গমনে ইচ্ছুক লোকদের গভীর রাতে ট্রলারে তুলে দিতো। ট্রলারে তুলে দেওয়ার পূর্বে তাদের
সকলের পাসপোর্ট এর কপি রাজুর নিকট রেখে দিতো। সে লোকজনদের বলতো বিদেশ পৌছানোর পর
বাকি টাকা পরিশোধ করলে তাদের নিকট পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিবে। ধৃত ৫নং আসামী ইউনুছ
নিবিড়ভাবে আসামী ইসমাইল ও শফিউল আলমদের মানব পাচারে লোক সংগ্রহের কাজে সহায়তা
করতো।
৩। ভুক্তভোগী ভিকটিম জয়নাল আবেদীন ধৃত ৩নং আসামী রিয়াজ খান রাজুকে বিশ্বাস করে
তার নিকট একটি পাসপোর্ট তৈরী করার জন্য যায়। রাজু তাকে পাসপোর্ট বানানোর কারণ
জিজ্ঞাসা করলে ভিকটিম বলে সুযোগ হলে কখনো বিদেশ যাবো। তখন রাজু ভিকটিমকে বলে, তাকে
কম টাকার মধ্যে মালয়েশিয়া পাঠাতে পারবে। তার মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে লোক আছে। এই কথার
প্রেক্ষিতে ভিকটিম রাজুকে পাসপোর্ট তৈরী করার জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫,০০০/- টাকা দেয়।
কিছু দিনের মধ্যে রাজু ভিকটিমকে পাসপোর্ট তৈরী করে দেয়। তখন ভিকটিম রাজুকে বিশ্বাস
করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পুনরায় ১,০০,০০০/- টাকা দেয় এবং বাকি টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর
পরিশোধ করলে হবে মর্মে রাজু জানায়। টাকা দেওয়ার ১৫ দিন পর রাজু ভিকটিমকে গভীর রাতে
পেকুয়া থানাধীন একটি ঘাট হতে ট্রলারে উঠিয়ে দেয়। ঐ ট্রলারে রাজুর মানব পাচার চক্রের
কয়েকজন সদস্যসহ আরো ১৫/২০ জন ভুক্তভোগী ছিলো। পরবর্তীতে তাদেরকে নিয়ে ২/৩দিন গভীর
সাগরে ঘুরাফেরা করে হঠাৎ গভীর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে মালয়েশিয়া চলে
এসেছে বলে ট্রলার থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়। সকাল হলে ভুক্তভোগীরা সবাই বুঝতে পারে যে,
রাজুর প্রতারণা করে তাদেরকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দিয়েছে। অতঃপর তারা কয়েকদিন
সেন্টমার্টিন দ্বীপে মানবেতার জীবন যাপন করে যে যার মতো করে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি এসে
রাজুর কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দেওয়া টাকা ফেরত চাইলে তাদের’কে মারধর করে এবং
অপহরণ পূর্বক মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে। রাজু স্থানীয়ভাবে পেকুয়া উপজেলা এলাকায় একজন
রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ভয়ে এলাকার কোন লোক কথা বলার সাহস পায় না। তার সাথে
লাগতে গেলে বাড়িঘর দখল করে বাড়ি ছাড়া করে দেয় এবং তার ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করার
সাহস পায় না। উল্লেখ্য যে, আসামী রিয়াজ খান রাজু উল্লেখিত ব্যক্তি সাথেই এরকম প্রতারণা
করেনি। সে তার আশ পাশের এলাকার আরও অনেক নিরীহ সাধারন মানুষদের সাথে একই পন্থায়
একইভাবে প্রতারনা করে আসছে।
৪। অন্যদিকে ভুক্তভোগী মোক্তার আলী ধৃত ৪নং আসামী হোসেন এর ছেলে এমরান এর মাধ্যমে
মোজাম্বিক যায়। মোক্তার আলী সেখানে গিয়ে এই চক্রের মাধ্যমেই অপহৃত হয়। পরবর্তীতে আসামী
হোসেন এর ছেলে এমরান অপহৃত মোক্তারের ভাই জয়নালকে জানায় যে, তার বাবা হোসেন আলীকে নগদ
৭,৮০,০০০/- টাকা দিলে মোক্তার হোসেনকে ছেড়ে দিবে। তখন জয়নাল আবেদীন তার ভাইকে ফিরে
পাওয়ার উদ্দেশ্যে হেসেনের বাড়ীতে গিয়ে উল্লেখিত টাকা গুলো দিয়ে আসে। তারপরও মোক্তার আলীর
কোন খোঁজ না মিলায় জয়নাল আবেদীন বাদী হয়ে হোসেন সহ তার দুই ছেলে ও আরো ৪ জন
সহযোগীর বিরুদ্ধে কক্সবাজার জেলার বাঁশখালী থানার একটি মামলা দায়ে করে, যার নং-২৭, তাং-
১৯/০৪/১৭, ধারা-৩৮৬/৩৪ পেনাল কোড। মূলত ধৃত আসামী মোঃ হোসেন মানব পাচার চক্রের অন্যতম
সদস্য তার ছেলের মাধ্যমে সে নিরীহ লোকজনদের মোজাম্বিক পাঠিয়ে তাদের এই চক্রের সদস্যের
দ্বারা বিভিন্নভাবে অপহরণ করে অপহৃত ব্যক্তিদের বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের নিকট হতে মোঃ
হোসেন মোটা অংকের টাকা আদায় করতো।
৫। উপরে উল্লেখিত ধৃত আসামীদের এরুপ অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করার
সাহস পায় না। তারা মালয়েশিয়া লোক পাঠানোর কথা বলে নিরীহ লোকজন টাকা দিতে না পারলে
তাদের নিকট হতে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে তাদেরকে অবৈধভাবে সাগর পথে ট্রলার যোগে
মালয়েশিয়া কোন এক অজ্ঞাত দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে আসে। এরপর তার পরিবারের নিকট থেকে
মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ চায়। দিতে না পারলে স্বাক্ষরযুক্ত স্ট্যাম্পের মাধ্যমে তাদের আবাদি জমি জমা
বাড়ি-ঘর দখল করে নেয়। ঐদিকে মালয়েশিয়া গামী লোক গুলো কোন এক দ্বীপে খাওয়ার অভাবে কেউ
কেউ মারাও যায়। আবার কেউ সাগরে ট্রলার ডুবেও মারা যায়।
৬। বর্ণিত আসামীদের এহেন অপকর্ম দীর্ঘদিন যাবত কোন লোক অভিযোগ করার সাহস পায় না।
একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে প্রত্যক্ষভাবে ০৫ জন ভুক্তভোগী ব্যক্তি আসামীদের এরুপ কার্যের বিরুদ্ধে
অধিনায়ক র্যাব-৭, চট্টগ্রাম বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করে। বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয় বিদারক ও
অমানবিক হওয়ায় র্যাব-৭ চট্টগ্রাম গুরুত্বের সহিত আমলে নিয়ে উল্লেখিত মানব পাচার চক্রের সাথে
জড়িতদের গ্রেফতার করার লক্ষ্যে ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারী এবং ছায়াতদন্ত শুরু করে। নজরদারীর
একপর্যায়ে র্যাব-৭, চট্টগ্রাম জানতে পারে যে, বর্ণিত মানব পাচারকারীর চক্রটি একত্রিত হয়ে
তাদের অপকর্মের সলাপরামর্শ করছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ এপ্রিল ২০২২ ইং তারিখ ১৫০০
ঘটিকায় র্যাব-৭, চট্টগ্রামের একটি চৌকষ আভিযানিক দল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বাঁশখালী
এবং পেকুয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আসামী ১। মোঃ ইসমাইল (৩২), ২। শফিউল আলম (৩৭),
উভয় পিতা-মোজাফফর আহাম্মদ, সাং- ছনুয়া, থানা-বাঁশখালী, জেলা-চট্টগ্রাম, ৩। রিয়াজ খান
রাজু (৪১), পিতা-সেকান্দার আলী, সাং- রাজাখালী, থানা-পেকুয়া, জেলা-কক্সবাজার, ৪। মোঃ হোসেন
(৬০), পিতা-মৃত চাঁন মিয়া, সাং-ছনুয়া সেলবন থানা-বাঁশখালী, জেলা-চট্টগ্রাম এবং ৫। মোঃ
ইউনুছ মাঝি (৫৬), পিতা-মৃত সৈয়দ আহাম্মদ, সাং-পশ্চিম সেলবন থানা-বাঁশখালী, জেলা-
চট্টগ্রাম’দেরকে আটক করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে উপস্থিত স্বাক্ষীদের সম্মাুখে আটককৃত
আসামীরা অকপটে স্বীকার করে যে, তাদের বাড়ী বিভিন্ন জায়গায় হলেও তারা মানব পাচার চক্রের
সক্রিয় সদস্য। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে নিরীহ মানুষদের
প্রতারিত করে নগদ অর্থ আদায়ের মাধ্যমে সাগর পথে ট্রলার যোগে অবৈধভাবে মালোশিয়া
পাঠানো যায় এবং মালোশিয়া পাঠানোর কথা বলে তাদেরকে বাংলাদেশের কোন এক নির্জন দ্বীপে
ফেলে আসা যায় সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য আসামী রিয়াজ খাঁন রাজুর বাসায় একত্রিত
হয়েছিল।
৭। আটককৃত আসামীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরো স্বীকার করে যে, উল্লেখিত
ভুক্তভোগী ০৫ জন ভিকটিমের সহিত প্রতারনার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ভিকটিমদের
আর্থ-সামাজিক দারিদ্রতা ও অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মালয়েশিয়া
বলে স্থানান্তর করে লক্ষ লক্ষ টাকা আতœসাৎ করেছে।
৮। গ্রেফতারকৃত আসামী সংক্রান্তে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট
থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।