যারা আজ জন্মালাম, আগামী ১০০ বছর পরেও আমাদের গুরুত্বের ব্যবধান থাকবে। বৃক্ষ-মাটি কারো কারো
শরীর থেকে বেশি পুষ্টি পাবে এবং আমাদের কারো কার হাড়-মাংস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারো কারো কবরে
নামফলক থাকবে কিন্তু স্মরণ করার মানুষ থাকবে না আবার কেউ কেউ কবর পাবে না কিন্তু পৃথিবীজুড়ে খবর
হবে, অমুকে ভালোলোক ছিলেন!
যাদের গতকাল ছিল, আজ আছে এবং আগামীকাল থাকবে তারা কতোকাল পৃথিবীতে থাকতে পারবে? পদ-
পদবীর বড়াই শেষে কবর দেশে আমাদের আবার দেখা হবে। ৭০/৮০ বছর বাদে আমাদের প্রত্যেকের দেহের
ওপরে বাঁশ-মাটির ছাদ থাকবে। সাপ-বিচ্ছুতে অল্পদিনেই আমাদের দেহাবশেষকে তাদের বিষ্ঠায় পরিণত করবে।
আমাদের হাড়-মাংস মাটিতে কিছুটা পুষ্টি জোগাবে। মাঝে মাঝে এলাকার মসজিদে, ইদগাহে অচেনা ইমামের
সুরেলা কণ্ঠের ঢালাও মোনাজাতে, 'এ পারার সকল মাইয়্যেতকে ক্ষমা করে দাও মাওলা' সামান্য হিস্যা পাবো।
জীবনের চারণভূমিতে কতোজনের কত ক্ষমতা থাকবে, দাপট থাকবে। কারো কারো আদেশে মানুষের জীবন চলে
যাবে। আবার কারো নিষেধে প্রাপ্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে । কারো কারো ইচ্ছায় জীবন রক্ষা পাবে! অথচ চূড়ান্ত
পরিণতিতে আমাদের কারোরই রেহাই নাই। পৃথিবীর অক্সিজেন আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। কোন ওষুধ-
চিকিৎসায় জীবন ধরে রাখা যাবে না। প্রিয়জনদের মায়ায়-কান্নায় মৃত্যুর রাস্তা থেকে বিচ্যূত করা যাবে না।
একবার খাটিয়ায় চার কাঁধে চড়তেই হবে! পাড়ি দিতে হবে কালের অনন্ত সেতু।
আমাদের সবল কালে ক্ষমতার দাপটে মাতাল না হয়ে, কাউকে জিম্মি করে কপাল ফেরাতে না চেয়ে, গালাগালি
করে কাউকে শত্রুতে পরিনত না করে কিংবা কারো অধিকার কেড়ে না নিয়ে জীবনের অল্প অবয়বটুকু আলোর
মালায় মোড়াতে পারি। কে রাজা আর কে মজুর-এই পরিচয় কতদিন থাকে? লাশের পরিচয়ে দাম্ভিক রাজা
হওয়ার চেয়ে সুবোধ প্রজা হওয়া বেশি গৌরবের। অতীব সম্মানের। আমার মৃত্যুতে মানুষ শোকাভিভূত না হোক,
আমায় মনে না রাখুক কিন্তু গালি যেনো না দেয়, মন্দ যেনো না কয়-জীবনভর এই কাজটুকু যেনো করে যেতে
পারি।
যে মানুষ জীবিতকালে মানবিক থাকেন সে মানুষ ওপারেও মাটির-পোকামাকড়ের জন্যেও উপকারী হন। একজন
খারাপ মানুষের লাশ বুকে নিয়ে কবরও খুশি হয় না। স্রষ্টার সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার আগেই তাকে খুশি করার
আমল নিয়ে যেতে হবে। যে আমল মানুষের যৌবনে, কর্মে, আচরণের মধ্যে নিহিত থাকে। আপনার প্রভূও
আপনাকে গ্রহণ করতে চান-পবিত্র আত্মায়। শুদ্ধ সত্তার সাথে মিলনে শুদ্ধতম সাধনা দরকার।
অল্পদিনের আয়ুতে চারপাশের বায়ুমন্ডলে উষ্মা, ক্রোধ, লোভ এবং হিংসা-জিঘাংসা না ছড়াই। আমার আমিত্বের
বড়াইয়ে যেনো না ডুবি। পার্থিব আচরণের মাধ্যমে অপার্থিব কড়াই শীতল হবে নাকি উষ্ণ-সেটা নির্ধারিত হবে।
কাউকে একটুখানি বঞ্চিত করলে, ব্যথা দিলে, অসম্মান করলে সেটা বহুগুন করে ফেরত নিতে হবে।
কাউকে দুঃখ দিয়ে, ঠকিয়ে, আঘাত করে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমা পাওয়া গেলেও আক্রান্তের অনুভূতি, দীর্ঘশ্বাসের কি
কোন বিনিময় হয়? যার যেটুকু পাওনা,যার যেটুকু দাবি সেটুকু তাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবেই মাটির বিছানায় আসা
উচিত। মাটির ক্রোধ অনেক বেশি। মন্দ মানুষের লাশ পেয়ে মাটি ক্রোধান্বিত হন। টক্সিক ব্যক্তির লাশ সাপ-
বিচ্ছুদের ছুঁতেও ঘৃণা হয়! জীবনকালের চেয়েও আমার মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে আরও বেশি আলোক নামুক-
এমন প্রত্যাশা করলে দুনিয়ায় আলোর সারথি হতে হবে। মানুষের মধ্যে ভেদ রেখে, লোভ পুষে, মিথ্যা আঁকড়ে,
ক্ষমতা দেখিয়ে, অবিচার করে আর যাইহোক পরবর্তী প্রত্যাশাকে পূরণ করা যাবে না।
এই ছোট্ট জীবন মহাকালের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্রাংশ। পূর্বসুরীদের পরিনতি থেকে শিক্ষা নিতে পারি এবং উত্তরসূরীদের
জন্য বার্তা রেখে যেতে পারি। সেখানে উঁচু-নিচু, ভেদ-অভেদে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। আমার কর্মই আমার
পরিনতি নির্ধারণ করবে। ক্ষমতার টুকরাংশ পেয়ে সেটার অপব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা, ঠকানো,
উস্কানি দেয়া ভালো মানুষের আচরণের লক্ষণ না। পৃথিবীতে কাউকে ঠকিয়ে এপারে এবং ওপারে কেউ জিতবে
সে আশায় গুঁড়েবালি! আসলে মানুষ মরিচ বাতি। নেভার জন্যে জ্বলে। কাজেই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ হোক
সাবধানে। বিবেক-বিবেচনা হোক কর্মনীতি।
রাজু আহমেদ। কলামিস্ট।
raju69alive@gmail.com