-জাপানিজ স্কলার ‘ফুমিকো ইয়ামাদর’ পাকিস্তানের বিখ্যাত বহুল প্রচারিত ‘দি নেশন’ পত্রিকাতে বিশ্লেষণ
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মসমর্পণ ও আদালতে গ্রেপ্তারের খবর, চীন ও রাশিয়াসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের ডলার বর্জন করে চীনা ইউয়ান মুদ্রার ব্যবহার এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর চীন সফরে চীনের প্রভাব শেষ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন সারা বিশ্ব খবর নিয়ে ব্যস্ত ছিল। বলা যায়, এর আওতাভুক্ত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে। গত সপ্তাহে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ইরান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে একটি পুনর্মিলন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক দেশ দুই মাসের মধ্যে অন্য দেশে দূতাবাস চালু করে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দেশ। উভয় দেশ 2001 সালে স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা চুক্তি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে। এই দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তি ইয়েমেন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। জানা গেছে, সৌদি আরব ও ওমানের একটি প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় যাচ্ছে। ইরান সমর্থিত হুথি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে তাদের সফর। এতে আট বছরের যুদ্ধের অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনের প্রচেষ্টা এবং মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে অন্ধকারে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সমঝোতা করে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মোড় নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে চীন। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবকে ক্ষুন্ন করবে। শোনা যাচ্ছে সৌদি আরব ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে—এখন থেকে পেট্রোডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময়ে তেল রপ্তানি করবে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য ট্রাম্প এবং বিডেন প্রশাসন উভয়কেই দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি কিছুদিন আগেও সৌদি আরব, ইরান, ইয়েমেনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই নতুন মেরুকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরাইল। গত কয়েক দশক ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরির জন্য কাজ করছে; আরব দেশগুলোর জন্য ইসরাইলকে মেনে নেওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ চারটি আরব মুসলিম দেশ একটি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা ধরে রাখতে পারেনি। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কর্তৃত্ব হ্রাসের কারণ খুঁজতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের শাসনামলের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়েছে। ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চলের নেতাদের সম্পর্কে যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন তা দেশগুলোর শাসকরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। এই অঞ্চলের নেতাদের প্রতি ট্রাম্পের শ্রদ্ধার অভাব, তিনি একাধিকবার প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন। জো বিডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই মনোভাব বদলায়নি। সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার অভাবকে প্রধান ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন বাইডেন। ট্রাম্প ও বিডেনের এমন অসম্মানজনক মনোভাব প্রকাশ করতে এই অঞ্চলের দেশগুলো ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে আসছে। তদুপরি, ট্রাম্পের মতো বিডেনও চীনের প্রতি অসংযত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছিলেন। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে যেতে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য ট্রাম্প এবং বিডেন প্রশাসন উভয়কেই দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি কিছুদিন আগেও সৌদি আরব, ইরান, ইয়েমেনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই নতুন মেরুকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরাইল। গত কয়েক দশক ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরির জন্য কাজ করছে; আরব দেশগুলোর জন্য ইসরাইলকে মেনে নেওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ চারটি আরব মুসলিম দেশ একটি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা ধরে রাখতে পারেনি। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী দেশ। 1974 সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সাথে একটি তেল রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তির মাধ্যমে ডলারকে পেট্রোডলারে রূপান্তর করা হয়। পেট্রোডলার হল ডলারের বিনিময়ে পেট্রোল কেনার চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরব ডলারকে সার্বভৌম বিশ্ব মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এর অর্থ হল পেট্রোল শুধুমাত্র ডলারে কেনা এবং বিক্রি করা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র যে ডলারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিণতি অনুভব করেছে। মার্কিন ডলার সুবিধাকে ভিন্নমতাবলম্বী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক সন্ত্রাস থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছে তাদের পরিণতি খুবই খারাপ হয়েছে। ইরাক এবং লিবিয়া তা করার চেষ্টা করেছিল এবং তাদের বর্তমান পরিণতি সর্বজনবিদিত। ইউক্রেনে অভিযানের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধেও এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে রাশিয়া তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার রিজার্ভের প্রায় $600 বিলিয়ন হিমায়িত করেছে, যা ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রিজার্ভ। এ ছাড়া রাশিয়ার অনেক ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন যোগাযোগ ব্যবস্থা সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ কারণে রাশিয়া ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারছে না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়ার পর অন্যান্য দেশ সতর্ক হয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দেশগুলো ডলারের বাইরে একটি আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছে, যাতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র আর একবার না করতে পারে।
মেহজাবিন বানু, বাংলাদেশের একজন লেখিকা, কলামিস্ট।