রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি:
রংপুরের গ্রামাঞ্চলের নারীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে হাতে টুপি তৈরির ধুম পড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী টুপির জোগান দিতে দিনরাত নারীরা নকশার কাজ করছে। তাঁদের বানানো টুপি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশের বাজারে স্থান করে নিয়েছে। কাউনিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা সুঁতার মাধমে টুপির কাপড়ে ফুলের নকশা করছে। আবার অনেককেই কাপড় কাটছে।
তৈরিকৃত এসব টুপি সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের ২০টি দেশ পাঠানো হয়। এছাড়াও অন্যান্য মুসলিম দেশেও রংপুরের এ টুপির চাহিদা রয়েছে অনেক। রপ্তানিমুখী টুপি কেন্দ্র করে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রামের ৩০ হাজারের বেশি নারী এখন টুপি তৈরি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
স্বামী পরিত্যক্তা ও হতদরিদ্র প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার নারীর মূল পেশাই এখন টুপির কাজ। সংসারের কাজ সামলে অবসরে টুপিতে নকশা বোনেন নারীরা। এতে বাড়তি আয়ে পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরাও হচ্ছে স্বাবলম্বী। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দী ও ভূতছাড়া গ্রামে দল বেঁধে নারী টুপি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
শুধু শহীদবাগ ইউনিয়নে নয় কাউনিয়া উপজেলার কমবেশি প্রতিটি গ্রামে আছে টুপি তৈরির কারিগর। টুপি তৈরির কারিগর নুরনাহার, মাজেদা, হাওয়া বেগম ও শেফালী বেগম বলেন, এবার টুপি তৈরির কাজের চাহিদা একটু বেশি। একেকটি টুপির নকশা বুননসহ অন্য কাজ মিলে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ দিন। মাসে গড়ে একজন কারিগর ৪-৫টি করে টুপি তৈরি করেন।
প্রতিটি টুপিতে নির্দিষ্ট নকশা ও সাইজ অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তারা। সংসারের অভাব ডিঙিয়ে আসা একই উপজেলার সাব্দী গ্রামের আংগুরা বেগম বলেন, স্বামীর টাকা দিয়্যা হামার সংসার ঠিকমতো চলে নাই। সোগসময় একটা না একটা সমস্যা নাগি আছিল। এ্যলা আল্লাহর রহমতে হামরা ভালো আছি। আগের মতো স্বামী-সন্তান নিয়্যা কষ্ট নাই।
সংসারের কামের পাশাপাশি এ্যলা টুপি সেলাইয়ের কামো করোং। কোনো মাসে ৩ হাজার, ফির কোনো মাসে ২ হাজার টাকা আয় হয়। খোর্দ্দ ভুতছড়া গ্রামের টুপি শ্রমিক আমেনা ও আনিছা বেগম বলেন, প্রায় ১২ বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। তাদের একেকজনের এখন মাসিক আয় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা।
তারা টুপির চারদিকে মোটা সুতা ঢোকানোর কাজ করেন, যাকে বলা হয় হাসু। এতে প্রতিটা টুপির জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা করে পেয়ে থাকেন তারা। কাউনিয়ার সাব্দী গ্রামে ১৯৯৮ সালে টুপির কাজ নিয়ে আসেন জহির উদ্দিন। ভোলা থেকে আসা এ ব্যক্তিকে তখন গ্রামের অনেকেই জায়গা দিতে রাজি হননি। বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে টুপি তৈরির শুরুটা দেখতে চেয়েছিলেন আবোর উদ্দিন। এখন তিনি বেঁচে নেই।
আবোর উদ্দিনের সেই বাসা থেকেই শুরু নারীদের হাতে সেলাই করা টুপির কাজ। শুরুর দিকে কয়েকজন নারী জড়িত থাকলেও ক্রমাগত তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তারপর মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু হয় এ টুপি। আরব দেশে এ টুপির চাহিদা বেশি থাকায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জহিরকে। বর্তমানে ওমানে তার দুটি টুপির দোকান রয়েছে।
কয়েকজন উদ্যোক্তা গ্রামে নিজ উদ্যোগে ছোট ছোট কারখানা দিয়েছে। এসব কর্মযজ্ঞে তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান, যা একসময়ের মঙ্গাকবলিত তিস্তা পাড়ের হতদরিদ্র হাজারো নারীকে দিয়েছে কাজের সুযোগ।
গ্রামীণ জনপদে টুপি শিল্পের বিকাশ ও সুযোগ বাড়াতে রংপুর অঞ্চলের নারীরাও দিনদিন এ কাজে আগ্রহী হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বারংপুরের দৃষ্টিনন্দন টুপি ২০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে