রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি: এক সময়ে মঙ্গা কবলিত রংপুর অঞ্চলে সোনারাঙা ধানে ভরে গেছে মাঠের পর মাঠ। ভোরের কুয়াশায় উদীয়মান সূর্যের আলোতে ঝিলমিল করছে ধানের শীষ। শুষ্ক বাতাসে হেলে-দুলে আমন ধানের ক্ষেত জানান দিচ্ছে মাঠ থেকে গোলায় ফেরার সময় হয়েছে। ধান পরিপক্ব হওয়ায় সারিবদ্ধ হয়ে কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। ধান কাটার পর বাঁধাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাড়াইয়ের জন্য বাড়ীতে। রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকগণ কাক ডাকা ভোরে বিছানা ত্যাগ মাঠে নামে যায় আমন ধান কাটাতে। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের হাতে। কৃষক পরিবারের পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে দিনমজুরদেরও। মাঠে দুলছে সোনারাঙা ধানের শীষ আর কৃষকের মনে প্রশান্তির আনন্দ। আগাম ধান কাটা মাড়াই শুরু হওয়ায় এখন কার্তিক মাসে শ্রমহীন থাকতে হচ্ছে না কৃষিশ্রমিকদের। বেশ আনন্দে রয়েছে কৃষকসহ শ্রমিকরা। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রংপুরে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষ হয়েছে। আগাম জাতের ধান কাটা শেষে আগাম জাতের আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছে চাষিরা। অনেকেই ধান কাটার পর জমিতে আলুর বীজ লাগিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশ জমির আগাম ধান কাটা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি উচ্চ ফলনশীল আগাম আমন ধান রোপণের ৮০-৯০ দিনের মধ্যে ধান পাকে। ধান কাটার পর আলুসহ নানা রবিশস্য চাষ করে থাকেন চাষিরা। সেই লক্ষ্যে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ, ডোমার, নীলফামারী সদর, রংপুরের সদর উপজেলা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়াসহ কয়েক উপজেলায় আগাম জাতের ধানের চাষ বেশি হয়। মাঠের পর মাঠ সবুজের মাঝে পাকা ধানক্ষেত। আগাম ধান কাটা নিয়ে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেই ধান ট্রাক্টরচালিত ট্রলিতে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার পর মাড়াইয়ের কাজ করা হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটা হচ্ছে। অনেকে আবার জমিতেই পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর মেশিন দিয়ে ধান মাড়াই করে নিচ্ছেন। নারীরা মাড়াই করা ধান বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন। আবার কেউ কেউ ধান মাড়াইয়ের পর শুকানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। রংপুর সদর উপজেলার শাহাবাজপুর এলাকার কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আগাম জাতের ধান ও আলু চাষ করে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও আগাম ধান চাষ করেছি। স্বল্পমেয়াদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান হওয়ায় লাভ হয়। রবিশস্যের জন্য বিখ্যাত মিঠাপুকুর এলাকার রসুল মিয়া বলেন, অনেকেই অন্যান্য আমন ধান রোপণ করলেও আমি উচ্চ ফলনশীল জাতের আগাম আমন ধান চাষ করেছি। এরই মধ্যে ধান পাকতে শুরু করেছে। কৃষিশ্রমিক মোতালেব হোসেন বলেন, এ সময়টায় এলাকায় কাজের চাহিদা কম। আগাম ধান চাষ হওয়ায় এখন ধান কাটা মাড়াই চলছে। মজুরি অন্য সময়ের তুলনায় কম। তারপরও যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে সংসার চলে। কৃষকরা বলেন, গত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছেন, অল্প কিছু জমিতে পঁচারি ও কারেন্ট পোকার আক্রমণ হলেও ফলন ভালো হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। পীরগাছার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বগুড়াপাড়া এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগাম জাতের ধান পাকায় কিছু ধান পাখি খেয়ে ফেলেছে। সব মিলিয়ে এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। অনেকেই ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। কেউ কেউ ধান মাঠ থেকে গোলায় তুলেছেন। এ বছর ধানের কাঁচা খড় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। সরকার যে দাম দিচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচের হিসেব কষলে লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে। রংপুর নগরীর সাহেবগঞ্জ এলাকার কৃষক শামছুল হক বলেন, আগে হামরা যে জমি দোন প্রতি ২০০ টাকা দিয়ে চাষ করছি, এ্যালা সেই জমিত খরচ হওছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তেলের দাম, সারের দামসহ সোগ কিছুর দাম বাড়ছে। সরকার ধানের দাম দিছে ২৮ টাকা আর চালের দাম ৪২ টাকা। এই দামে হামার মতো কৃষকের লাভ হবার নায়, উল্টা লোকসান হইবে। মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি সেরুডাঙ্গা এলাকার আব্দুর রহমান বলেন, নিজে কামলা দিয়াও হামার পোষায় না। একটা জমি চাষ দিবার গেইলে নাগে ১২০০ টাকা। আর এ্যালা ধান কাটাতে নাগোচে সাড়ে তিনশ টাকা। হিসাব করি দেখো হামাক কত খরচ করা নাগে। এবার ফলন ভালো হইছে কিন্তু সরকার যে দাম দিছে তাতে লোকসানের ভয় আছে। এমনটা হইলে তো মাইনসে ধান ছাড়ি অন্য কিছু চাষ করবে। এদিকে সরকার নির্ধারিত দাম বৃদ্ধির দাবি করে কৃষকগণ বলেন, এমন পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধির সবদিক বিবেচনা করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও চাষাবাদে উৎসাহ বাড়াতে সরকারকে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষক আসলে কতটুকু লাভের মুখ দেখবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া, তাতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ কারণে উৎপাদক বা কৃষকরা প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও বাধা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা বেশি উপকৃত হবে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন , ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। মূলত আলু ও অন্যান্য রবিশস্যের জন্য কৃষকরা আগাম জাতের ধান চাষ করে থাকেন। চলতি আমন মৌসুমে রংপুর মহানগরসহ আট উপজেলায় হাইব্রিড, উফসী ও স্থানীয় মিলে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছে। এর আগের মৌসুমের তুলনায় এবার ২৫০ হেক্টর জমিতে চাষ বেড়েছে। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি ভালো ফলন হয়েছে। ২০২০-২১ মৌসুমে ১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর, ২০১৯-২০ মৌসুমে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ৮০৫ হেক্টর, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩৯৫ হেক্টর এবং ২০১৭-১৮ মৌসুমে ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৯৬১ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়েছিল।
রংপুরে কার্তিক মাসে আগাম জাতে আমন ধানে কৃষকের মুখে হাস
-
by admin

- Categories: রংপুর বিভাগ
Related Content
কুড়িগ্রামে কিশোরীকে ১৮ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ
by admin মার্চ ২০, ২০২৫
মধ্যপাড়া পাথর খনি এক মাস বন্ধের পর উত্তোলন শুরু
by admin মার্চ ২০, ২০২৫
দিনাজপুরে সূর্যমুখীর পাইলট উৎপাদন নিয়ে মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত
by admin মার্চ ২০, ২০২৫
উলিপুরে পাটচাষী প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
by admin মার্চ ১৯, ২০২৫