রমজানের প্রস্তুতি রজব থেকেই

পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে, মুসলমানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসেই পবিত্র কালামুল্লাহ অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমানগণ পবিত্র রমজান মাসের জন্য পুরো এক বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। রমজান মাস হচ্ছে, পবিত্র, বরকতময় মাস। গোনাহ মাফের মাস। সকল গোনাহ, দুশ্চিন্তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় এ মাসে। দোয়া কবুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো থাকে এমাসেই।

রমজানের কল্যাণ অর্জনের লক্ষ্যে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় রজব থেকে। ফলে রজব মাস হচ্ছে, রমজানের প্রস্তুতির মাস। রমজানের অত্যধিক গুরুত্বের কারণে রজব মাসও হয়ে উঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। বিভিন্ন বিষয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এমাস থেকে। রজব মাসে রমজানের প্রস্তুতিমূলক দশটি বিষয় নিয়ে আজকের আয়োজন।

এক. দোয়া: রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে সালাফগণ এমাসে বেশি বেশি দোয়া করতেন। যেন আল্লাহ তায়ালা রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন। সালাফদের এটা স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। এখনও আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাগণ রমজান পর্যন্ত পৌঁছার জন্য বেশি বেশি দোয়া করেন।

সুতরাং আমাদের উচিত হলো আল্লাহর তায়ালার কাছে দোয়া করা, যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুস্থতার সঙ্গে রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করেন। দ্বীনের ওপর অটল রাখেন। এবং আমাদেরকে যেন তার ইবাদত ও আনুগত্য একান্তভাবে করার তাওফিক দেন।

দুই. তওবা করা: রমজানের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ মাস আমাদের মাঝে আসবে আর আমরা অবাধ্যতা, গোনাহে লিপ্ত থাকব, মানুষের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ, শত্রুতায় মেতে থাকব, এটা কল্পনাও করা যায় না।

সুতরাং রমজান আসার আগেই আমাদের প্রত্যেকের জন্য জরুরি হলো, মন থেকে খাঁটি তওবা করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। অতঃপর উচিত হলো, প্রথমে হকুকুল্লা তথা আমাদের এবং রবের মাঝে সংঘটিত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করা। তারপর হুকুকুল ইবাদ তথা আমাদের এবং অপর বান্দার মাঝে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, সেগুলো সমাধান করা। যাতে আগত পবিত্র এই মাসকে শান্তি, স্থিরতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে মন থেকে অভ্যর্থনা জানাতে পারি।

তিন. জানা জ্ঞান অর্জন করা: রমজান আগমনের পূর্বেই, রমজানের উপকারিতা, ফজিলত, শ্রেষ্ঠত্ব এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে তার বড়ত্ব ও বিধিবিধান সম্পর্কে জেনে নেয়া উচিত। রোজা, তারাবিহর মাসয়ালা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে নেয়া, যাতে করে তা রমজানের ইবাদতে সহযোগী হয়। এবং আমরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি তালাশ করতে পারি।

চার. নিজেকে অবসর করা: আমরা সারা বছর দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে ফেলি। কিন্তু পবিত্র রমজানের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের জন্য অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা মোটেও ঠিক হবে না। দুনিয়ার সকল ব্যস্ততাকে অবসর দিয়ে বিভিন্ন আমল, ইবাদত, নেক কাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখা উচিত। এই মাসে দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মগুলোকে বাদ দিতে বলা হচ্ছে না। বরং যে সমস্ত কাজ রমজানের আগে বা পরে করা যায়, সেগুলো থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার কথা বলা হচ্ছে। যাতে দুনিয়ার ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে আমরা রমযানে প্রবেশ করতে পারি।

পাঁচ. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে অগ্রগামী হওয়া: সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে পূর্ণ বিরত থাকা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন মাখলুক সৃষ্টি করা শেষ করলেন, তখন রাহিম (রক্ত সম্পর্ক) দাঁড়িয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালার কুদরতি আঁচল টেনে ধরল। আল্লাহ তায়ালা বললেন, থামো! সে বলল, রক্তসম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি থেকে আশ্রয় কামনা করছি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব আর যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব? সে বলল, অবশ্যই আমি সন্তুষ্ট হে রব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এমনটিই হবে। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, ইচ্ছা হলে তোমরা পড়, ‘যদি তোমাদেরকে অধিষ্ঠিত করা হতো, তাহলে তো তোমরা কেবল ফ্যাসাদই সৃষ্টি করতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে।’ সুরা মুহাম্মদ: ২২ (সহিহ বুখারি ৪৮৩০)

ছয়. কাযা রোজা: শরয়ি কোনো ওজরের কারণে পূর্বের রমজানের যদি কোনো রোজা কাযা থেকে থাকে, তাহলে তা আদায় করে ফেলা। রোজা ছেড়ে দেয়া তো কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন মুসলমান কোনোভাবেই রোজা ছাড়তে পারে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরিয়ত অনুমোদন দিয়েছে। আর শরয়ি ওজর ছাড়া যদি কেউ রোজা ছেড়ে দিয়ে থাকে, (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে তাকে কাফফারা দিতে হবে। তারপর তাওবা করতে হবে।

সাত. লম্বা লম্বা দোয়াতে অভ্যস্ত হওয়া: রমজান আসার আগেই রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত লম্বা লম্বা দোয়া মুখস্থ করা, যেগুলো জাওয়ামিউল কালিম তথা ব্যাপক অর্থবোধক হবে। অধিক কল্যাণ, বরকত ধারণকারী হবে।

আট. ওমরাহ-এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া: আপনি যদি আল্লাহর রহমতে রমযানে ওমরাহ করার নিয়ত করে থাকেন, তাহলে শাবানের শেষ দশদিন অন্তত অর্ধঘণ্টা করে হাঁটুন। কারণ রমযানে ওমরাহতে শারীরিক পরিশ্রম বেশি হবে।

সুতরাং তার জন্য প্রস্তুতি নিন। আগে থেকেই হাঁটার অভ্যাস থাকলে কষ্ট কম হবে।

নয়. কম ঘুমানো: আপনি যদি রাতে আট ঘণ্টা ঘুমে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলে এখন থেকে ছয় ঘণ্টা বা তার চেয়ে কম ঘুমানোর অভ্যাস করেন। কারণ রমজান হচ্ছে ইবাদতের মাস। আপনাকে প্রচুর ইবাদত করতে হবে। তাহাজ্জুদ পড়তে হবে। তাছাড়া রাতের শুরু অংশে তারাবিহ, শেষাংশে সাহরিতে সময় দিতে হবে। তবে কম ঘুমানোর ফলে সুস্থতা এবং স্বাস্থ্যে ব্যঘাত ঘটতে পারে। তাই দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিবেন। রমযানে ঘুম কম হলে, খুব বেশি ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহওয়ালাগণ তো রমযানে সারারাত জাগ্রত থাকেন।

দশ. রজব থেকে কম খাওয়ার অভ্যাস করেন: যাতে রমযানে অধিক আহার গ্রহণ ইবাদতে বিঘ্নিত করতে না পারে। অনেক সময় আমরা খুব বেশি সাহরি খাই, শরীর ভারি হয়ে যায়। বিছানায় গা এলিয়ে দেই আর মসজিদে যেতে পারি না। খাবার হজম হতেও অনেক সময় নেয়। পেটে গ্যাস তৈরি হয়। দুর্গন্ধযুক্ত ঢেকুর আসতে থাকে। ইফতারিতেও আমরা অনেক সময় নষ্ট করি; অনেক বেশি আহার গ্রহণ করতে গিয়ে মসজিদের জামাত ছুটে যায়। এতে রোজার মৌলিক উদ্দেশ্যে বিঘ্ন ঘটে। সারাদিনের উপবাসে নিজের প্রবৃত্তিকে যতটা না দমন করি, একবারের আহারে তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে।

সুতরাং এখন থেকেই খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে। আর শাকসবজি, ফল এবং শরীরের শক্তি, উদ্যমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবার বেশি করে খেতে হবে। যাতে করে রমযানে পূর্ণ আগ্রহের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ইবাদত করা যায়।

আরবি নিবন্ধ অবলম্বনে

Exit mobile version