(০১)
স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি
-বিচিত্র কুমার
স্বাধীনতা—তোমার অর্থ কী?
কেবল একটুকরো পতাকা?
নাকি বাতাসের বুকে গর্জন তোলা ইতিহাসের শিখা?
তুমি কি খোলা আকাশের মতো উদার?
নাকি বজ্রনিনাদের মতো প্রচণ্ড তেজস্বী?
আমি দেখি তোমায় ভোরের প্রথম আলোয়,
যেখানে শিশিরবিন্দুর মতো স্বপ্ন ঝলমল করে,
দেখি রক্তিম সূর্যের কিরণ হয়ে
তুমি জ্বলে ওঠো একেকটি শহীদের কপালে।
স্বাধীনতা মানে কি কেবল যুদ্ধের গান?
নাকি মা-বাবার কপালে ছোঁয়া শিউলি সুবাস?
স্বাধীনতা কি নিঃশব্দ কান্না,
যা বয়ে যায় বিধবার শাড়ির কোণে?
নাকি নবজাতকের হাসি,
যে প্রথম শ্বাস নেয় মুক্ত আকাশের নিচে?
তুমি কি রণক্ষেত্রে ঝরা রক্ত?
নাকি কৃষকের ঘামে ভেজা মাঠের সবুজ?
তুমি কি বন্দীশালার দেয়ালে লেখা রক্তাক্ত কবিতা?
নাকি মায়ের দোয়ার সামনে জ্বলতে থাকা প্রদীপ?
আমি দেখেছি তোমায় বধ্যভূমির স্তব্ধতায়,
যেখানে গুলির শব্দ হয়ে গেছে বাতাসের অনুবাদ,
আমি শুনেছি তোমায় মাতৃভাষার উচ্চারণে,
যেখানে প্রতিটি বর্ণ গাঁথা আছে আত্মত্যাগের মুক্তোয়।
তুমি ছিলে বাঙালির মুখে সেই আগুন,
যা বয়ে গেছে বজ্রবৃষ্টি হয়ে,
তুমি ছিলে একাত্তরের সেই ঝড়,
যা শেকল ভেঙে বুনেছিলো নতুন ভোর।
স্বাধীনতা, তুমি কি কেবলই ইতিহাসের পাতা?
নাকি প্রতিটি শিশুর চোখে ভাসা উজ্জ্বল স্বপ্ন?
তুমি কি নেতা-মন্ত্রীর ভাষণমালা?
নাকি ভুখা পেটের হাহাকার?
আমি চাই না, তুমি শুধু মুখরিত হও স্লোগানে,
আমি চাই না, তুমি বন্দী হও সংবিধানের ফ্রেমে,
আমি চাই তুমি থাকো মানুষের বুকে,
থাকো তার স্পন্দনে, থাকো তার ধমনীতে।
স্বাধীনতা মানে একজোড়া কর্মঠ হাত,
যে হাত লাঙল ধরে, যে হাত কলম ধরে,
স্বাধীনতা মানে এক টুকরো হাসি,
যে হাসিতে নেই অপমান, নেই অবহেলা।
স্বাধীনতা মানে তুমি—
একটি বিশুদ্ধ নীল আকাশ,
যেখানে চিল উড়ে যায় নিঃশঙ্ক,
যেখানে মানুষ হাঁটে নিজের ছায়ায়,
আর শিশুরা শিখে ভালোবাসার ভাষা।
স্বাধীনতা, তুমি নদীর স্রোতের মতো বইবে অনন্তকাল,
মানুষের হৃদয়ে, মানুষের স্বপ্নে,
এই মাটির শেকড়ে, এই আকাশের গানে।
(০২)
স্বাধীনতার অমর গান
-বিচিত্র কুমার
স্বাধীনতা, তুমি যে চিরন্তন আগুন,
যে আগুন কখনো নিভে না,
জীবনের গভীরে, অন্ধকারে, সঙ্গীহীন রাতে,
তুমি এক আলোর দিশারি, তোমার পথে পথিকেরা হাঁটে।
তুমি যেন একটি বেদনার্ত গান,
যার সুরে রক্তের আঠার মতো অনুভূতি মিশে থাকে,
তুমি সেই নদী, যে নদী রক্ত ও অশ্রু মিশিয়ে বয়ে চলে,
তুমি সেসব কষ্টের বীজ, যে বীজ একদিন অমৃত হয়ে ফুটে ওঠে।
তুমি প্রকৃতির গভীরে বিস্মৃত স্বপ্ন,
যে স্বপ্ন হারিয়ে গেলে মনের ক্ষত ঢেকে যায় না,
তুমি কষ্টের বায়ু, শীতলতা হয়ে
আমাদের শরীরে এক দগ্ধ অনুভূতি জাগিয়ে রাখো।
তুমি আকাশের এক অচেনা রং,
যে রং কখনো সরে যায় না পৃথিবীর আকাশ থেকে,
তুমি সেই বাতাস, যা শুকনো জমিনে চিরকাল প্রবাহিত,
তুমি পাহাড়ের গা থেকে ঝরানো জলধারা,
যা কখনো রুদ্ধ হয় না, মুক্তির গতি ধরে।
তুমি সেই ফুলের পাপড়ি, যে পাপড়ি একদিন মাটি খুঁজে ফিরে,
যে মাটি আমাদের পায়ের নিচে ভাঙা, ক্ষতবিক্ষত,
তুমি সে রক্তাক্ত সমাধি, যে সমাধি একদিন জীবনে ফিরে আসে,
কিন্তু তার গন্ধে থাকে কেবল কান্নার শব্দ,
স্বাধীনতা, তুমি যে কান্নার গভীরতা,
যে কান্না একদিন হাসির রূপ নেবে।
তুমি সেই ঘাস, যেটি মাটি থেকে উঠে অন্ধকারে হারায়,
তুমি সেই স্মৃতি, যা কখনো মুক্ত হয় না,
তুমি সেই অনন্ত যাত্রা, যে যাত্রা কখনো শেষ হয় না,
স্বাধীনতা, তুমি এক অসমাপ্ত কবিতা,
যার প্রতিটি চরণে লুকিয়ে থাকে আমাদের রক্ত, আমাদের ঘাম,
আমাদের অশ্রু, আমাদের হাসি—
যার অস্তিত্ব অমর, তার উজ্জ্বলতা শেষহীন।
তুমি আমাদের পরাভব ও বিজয়ের মিশ্রণ,
তুমি সেই পরবর্তী ভোরের সূর্য,
যে সূর্য, প্রত্যেক দিনের শুরুর সঙ্গী,
তুমি বেঁচে থাকা এক শাশ্বত বিশ্বাস,
যার মধ্যে আমরা কখনো হারাই না,
কখনো শেষ হয় না,
কখনো নিঃশেষিত হয় না।
(০৩)
স্বাধীনতা
-বিচিত্র কুমার
স্বাধীনতা, তুমি রৌদ্রের মতো,
অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে থাকা, যেমন চাঁদ
গভীর রাতে একাকী আলো ছড়িয়ে যায়।
তুমি ধরণীর বিশালতায়, এক সূর্যস্তরের তলায়,
যেমন মরু-বালির মাঝে এক জলধারা।
স্বাধীনতা, তুমি আকাশের বায়ু,
তুমি নদীর স্রোত, কখনো শান্ত, কখনো জোয়ার।
যেমন পাহাড়ের চূড়ায় হাওয়ার লহরী,
মৃত্যুর মুখেও তুমি হাসো, অসীম সাহসের সুরে।
তুমি বনে বনে, বনস্পতির মতো,
যেমন পাখির ডানায় হারানো স্বাধীনতার গান।
গল্প হয়ে ভেসে উঠো পাহাড়ি হাওয়া,
তুমি সে নদী, যে সাগরে মিলন ঘটায়,
যেমন দুটি হৃদয়ের মিলন।
স্বাধীনতা, তুমি শিশুর খেলনা,
যতই সময় চলে, ততই তুমি স্পর্শে আসো,
তুমি সেই ফুল, যার গন্ধে মুছে যায় ক্ষণস্থায়ী ব্যথা,
যেমন একসময় আসা বৃষ্টির ধারায় ধুয়ে যায় স্মৃতি।
তুমি প্রকৃতির চোখে দ্যুতি,
যেমন অন্ধকারে জ্বলে ওঠে মর্মর বাতি।
যতবার নকশার মতো বিভক্ত হয়ে আসে,
ততবার তুমি উড়ে যাও, অতলান্তে পাখির মতো।
স্বাধীনতা, তুমি অন্তরাত্মার হর্ষ,
যেমন নদীর ধারায় এক স্পন্দন,
তুমি সৃষ্টির জয়গানে উজ্জ্বল রাহা,
যতবার তোমার নাম উচ্চারিত হয়,
ততবার ফিরে আসে জীবনের খুশির বার্তা।
স্বাধীনতা, তুমি বসন্তের অঙ্গ,
যেমন পাখির সঙ্গীত ডানা মেলে প্রান্তরে।
তুমি চিরকালীন, অমলিন, এক অন্তহীন স্বপ্ন,
যেমন অঙ্কুর থেকে বৃক্ষ হয়ে ওঠো,
মাঝে মাঝে অজানা, তবে চিরস্থায়ী।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।