(০১)
লাল সবুজের বেলুন
– বিচিত্র কুমার
সকালের আলো ফুটতেই গ্রামজুড়ে শুরু হলো সাজসাজ রব। আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। খোকা আর মিতা, দুই ভাইবোন, ভোর থেকেই উত্তেজিত। মিতা খোপায় বেঁধেছে লাল-সবুজের ফিতে, আর খোকা হাতে ধরেছে লাল-সবুজ রঙের কয়েকটি বেলুন। তারা মায়ের হাত ধরে স্কুলের দিকে রওনা হলো।
স্কুল মাঠে পৌঁছে খোকা আর মিতা অবাক হয়ে দেখল, চারদিকে ছোট ছোট পতাকা উড়ছে। মঞ্চটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। লাল-সবুজের কাপড় দিয়ে তৈরি গেটটা যেন দেশের পতাকার প্রতিচ্ছবি। প্রধান শিক্ষক মাইকে ঘোষণা করলেন, “সবাই মনোযোগ দিন, আমাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে!”
মিতা কৌতূহল নিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করল, “মা, বিজয় দিবস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?” মা একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “আজকের দিনে আমরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। এই স্বাধীনতার পেছনে আছে অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ আর সংগ্রামের গল্প।”
খোকা মায়ের কথা শুনে আরও জানতে চাইল, “তাহলে আমরা কি কিছু করতে পারি দেশের জন্য?” মা বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের ভালো মানুষ হতে হবে, সৎভাবে কাজ করতে হবে। এটাই হবে দেশের প্রতি তোমাদের দায়িত্ব।”
অনুষ্ঠান শুরু হলো জাতীয় সংগীত দিয়ে। মাঠভর্তি শিশু-কিশোর আর বড়রা একসঙ্গে গাইল, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” গানের শব্দে যেন চারদিক কেঁপে উঠল। এরপর প্রধান শিক্ষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটি গল্প বললেন।
গল্পটি ছিল গ্রামেরই এক মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর। তিনি ছিলেন একজন কৃষক। কিন্তু দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। একদিন শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। প্রধান শিক্ষক বললেন, “আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ ফজলুর মতো বীরদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। তাদের আমরা কখনো ভুলব না।”
গল্পটি শুনে খোকা আর মিতা গভীরভাবে ভাবল। মিতা বলল, “মা, ফজলু চাচার মতো মানুষের জন্যই আমরা আজ স্কুলে যেতে পারি, খেলতে পারি, আনন্দ করতে পারি, তাই না?” মা গর্বের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, আর এ কারণেই তোমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশের জন্য ভালো কাজ করতে হবে।”
এরপর এল বেলুন উড়ানোর পালা। মাঠের মাঝখানে লাল-সবুজ রঙের বিশাল একটি বেলুনের তোড়া বাঁধা ছিল। প্রতিটি শিশুর হাতে দেওয়া হলো একটি করে লাল-সবুজ বেলুন। প্রধান শিক্ষক বললেন, “এই বেলুন আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। লাল রঙ আমাদের শহীদদের রক্তের কথা মনে করায়, আর সবুজ রঙ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক।”
সবাই একসঙ্গে বেলুনগুলো আকাশে ছেড়ে দিল। লাল-সবুজ বেলুনগুলো মিলে আকাশে একটি বিশাল রংধনুর মতো দৃশ্য তৈরি করল। বেলুনগুলো উড়তে উড়তে দূর আকাশে মিলিয়ে গেল। খোকা বেলুন ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের দেশটা কত সুন্দর! আমরা সবাই যদি ভালো কাজ করি, তাহলে দেশ আরও সুন্দর হবে।”
অনুষ্ঠানের শেষে সবাই একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল, “আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসব, দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করব, আর অন্যায় থেকে দূরে থাকব।” মিতা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “আমি বড় হয়ে দেশের জন্য কাজ করব!”
সন্ধ্যার আলো যখন নরম হয়ে এলো, খোকা আর মিতা মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরল। আকাশে তখনো কিছু বেলুন উড়ছিল। মিতা বলল, “এই বেলুনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে দেশকে ভালোবাসা আর সৎ হওয়াই সবচেয়ে বড় কাজ।”
মা তাদের গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “তোমরা যদি ভালো মানুষ হও, আমাদের দেশও ভালো থাকবে।” বিজয় দিবসের এই দিনটি খোকা আর মিতার মনে চিরদিনের জন্য রয়ে গেল। লাল-সবুজের বেলুন তাদের মনে স্বাধীনতার গল্প শোনালো, আর তাদের ভেতরে জাগিয়ে তুলল এক নতুন দেশের স্বপ্ন।
(০২)
বিজয়ের ডাকপাখি
– বিচিত্র কুমার
শীতের সকালে একটি ছোট গ্রামে এক ছেলে, রাফি, ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হচ্ছিল স্কুলের জন্য। গ্রামের উঠোনে লাল-সবুজ পতাকা উড়ছিল, আর তার মা খুঁটি থেকে ওই পতাকা নামিয়ে ঠিক করে রাখছিল। আজ বিজয় দিবস, আর রাফির স্কুলে একটি নাটক হবে। স্কুলে যাওয়ার পথে সে চিন্তা করতে লাগল, “আজকের নাটকে আমি কী করব?”
স্কুলে এসে শিক্ষকের কাছে জানল যে নাটকটি হবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং সবার অংশগ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক বললেন, “রাফি, তুমি ডাকপাখির চরিত্রে অভিনয় করবে। তোমার কাজ হবে বিজয়ের বার্তা দেয়া।” রাফি এক মুহূর্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ডাকপাখি কেন, স্যার?” শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, “ডাকপাখি ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। একসময় পাখির মাধ্যমে যুদ্ধের খবর পৌঁছাত এবং মানুষের মধ্যে যোগাযোগ হতো। এই নাটকে তুমি সেই ডাকপাখির মতো বিজয়ের বার্তা দেবে।”
রাফি তখনই বুঝতে পারল, ডাকপাখি হতে হলে তাকে ইতিহাসটা ভালোভাবে জানতে হবে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে মা-কে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে বলল। মা তাকে বললেন, “তোমার দাদু, মানে আমার বাবা, একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি যুদ্ধের সময় গ্রাম গ্রাম গিয়ে স্বাধীনতার খবর পৌঁছাতেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন।” রাফির চোখে চোখে দৃঢ়তা ফিরে এল। তার মনে হতে লাগল, সে শুধু নাটকে নয়, জীবনে সত্যিকারের বিজয়ের ডাকপাখি হতে চায়।
১৬ ডিসেম্বর, নাটকের দিন। স্কুলে উৎসবের পরিবেশ। মঞ্চে বড় একটি লাল-সবুজ পতাকা টানানো। রাফি সাদা পাঞ্জাবি পরা, গায়ে লাল গামছা জড়ানো, বুকভরা গর্ব নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে। নাটকের গল্প চলতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের নানা দুঃখ, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। সবশেষে রাফি ডাকপাখির চরিত্রে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ডাকপাখি। আমি তোমাদের জানাতে এসেছি—আমাদের দেশ স্বাধীন। লাল-সবুজ পতাকা আমাদের বিজয়ের প্রতীক। যারা জীবন দিয়েছে, তাদের আমরা কখনও ভুলব না। আমরা তাদের আত্মত্যাগের মূল্য দিতে দেশকে গড়ব।”
রাফির কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল, যা সবাইকে অভিভূত করে। ছাত্ররা করতালি দিল এবং শিক্ষকের চোখে অশ্রু এল। রাফি বুঝতে পারল, আজ সে শুধু নাটকে নয়, আসলেই একটি ডাকপাখি হয়ে উঠেছে, যারা দেশের বিজয়ের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে বিজয় দিবস শুধু আনন্দের দিন নয়, এটি আমাদের দায়িত্বের দিনও। যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের নিজেদের কাজের মাধ্যমে দেশকে গড়তে হবে। রাফির মতো আমরা সবাই যদি নিজেদের দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী হই, তবে আমাদের দেশ আরও সমৃদ্ধ হবে। বিজয়ের ডাকপাখি শুধু নাটকের চরিত্র নয়, এটি আমাদের দেশের ভবিষ্যতের প্রতীক।
(০৩)
মুক্তিযুদ্ধের গল্পের রাজা
– বিচিত্র কুমার
বাংলাদেশের বিজয় দিবস, ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। এই দিনটি সারা দেশের মানুষের মনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছে। আজকের গল্পটি একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু, যেখানে এক ছোট ছেলে, রাহুল, তার দাদির কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে পছন্দ করত। দাদির মুখে এক এক করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে রাহুল সবসময় ভাবত, যদি সে সেই সময় থাকতে পারত!
এবার রাহুলের স্কুলে বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। শিক্ষকরা ঘোষণা করেছিলেন, “আজকের দিনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবো, যার মাধ্যমে আমাদের দেশের স্বাধীনতা এসেছে।”
রাহুল খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে ভাবছিল, “আজ হয়তো আমি মুক্তিযুদ্ধের রাজা হতে পারবো!” কিন্তু কীভাবে? সে জানত না, তবে তার দাদির গল্পগুলো মনে ছিল। সে মন দিয়ে ঠিক করল, বিজয় দিবসে সে এক অসাধারণ গল্প শোনাবে।
সে দিন সকালে রাহুল স্কুলে গিয়ে তার বন্ধুদের জানাল, “আজ আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলব।” বন্ধুরা সবাই রাহুলকে উৎসাহ দিল, এবং তার পাশেই বসে থাকল।
স্কুলের অনুষ্ঠানে প্রথমে শিক্ষকরা স্বাধীনতার ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শোনালেন, তারপর রাহুলের পালা এল। রাহুল সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ আমি আপনাদের একটি গল্প শোনাবো, যে গল্প মুক্তিযুদ্ধের রাজা সম্পর্কে।”
রাহুল গল্প শুরু করল:
“একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে স্বাধীনতা ছিল না। শত্রুরা আমাদের শাসন করত, আর আমরা সবসময় তাদের অধীন থাকতাম। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু সাহসী মানুষ, যারা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামে পরিচিত, তারা একসাথে লড়াই শুরু করে। তারা জানত, তারা যদি একত্রিত না হয়, তবে দেশ কখনো স্বাধীন হবে না।”
রাহুল একটু থামল, যেন সবাই গল্পে মনোযোগী হয়। তারপর সে আবার শুরু করল:
“এই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘গল্পের রাজা’। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু তার মনে ছিল এক অসম্ভব সাহস। তিনি জানতেন, স্বাধীনতা পাওয়া মানে শুধু দেশের জন্য নয়, সবার জন্য এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করা। তার সাহস এবং আশা সকলকে একত্রিত করেছিল। সবাই তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে ছিল প্রস্তুত।”
রাহুল এক এক করে বলল, “মুক্তিযুদ্ধ ছিল খুব কঠিন, অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, অনেক পরিবার ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তারা জানত, এই লড়াই শেষ হলে এক নতুন বাংলাদেশ জন্ম নেবে। গল্পের রাজা জানতেন, তাদের স্বাধীনতা অতি মূল্যবান।”
রাহুলের গল্পটি পুরো শ্রোতা মহলে এক অবিস্মরণীয় শান্তি নিয়ে গেছিল। যখন সে শেষ করল, তখন সে বলল, “মুক্তিযুদ্ধের রাজা শুধু একজন ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। তাদের সাহস আর ভালোবাসাই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আমরা তাদের কৃতজ্ঞ।”
স্কুলের সবাই রাহুলের গল্প শুনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল। শিক্ষকও বললেন, “এই গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কখনো সহজে আসে না, সেটা অর্জন করতে হয়।”
রাহুল হাসি মুখে বলল, “আজকের এই দিনটি আমরা শুধু বিজয়ী হওয়ার জন্য উদযাপন করি না, আমরা এই দেশ ও তার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও কৃতজ্ঞ। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে।”
অবশেষে, স্কুলে একটি ছোটো অনুষ্ঠান হয়, যেখানে সবাই জাতীয় সংগীত গায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়। রাহুলও বুঝতে পারল, বিজয় দিবস শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের অতীতের সাহসিকতা ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার একটি বিশেষ উপলক্ষ।
রাহুলের গল্প শুধু তার বন্ধুদের মনের মধ্যে নয়, সবার মনে গেঁথে গেল, কারণ সে জানিয়ে দিল, “মুক্তিযুদ্ধের গল্পের রাজা হতে হলে, একদিন আমাদের দেশ এবং দেশের জন্য ভাল কিছু করার প্রয়োজন।”
এভাবেই, রাহুল বুঝল, বিজয় দিবসের আসল মানে হলো একে অপরকে সম্মান জানানো, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশের প্রতি ভালবাসা।
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
Post Views: 39
Like this:
Like Loading...
Related