সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (২২ জানুয়ারি) এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অভিযোগের তালিকায় রয়েছে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন, জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অনুসন্ধান শুরুর বিষয়টি জানান।
তিনি বলেন, ওই নির্বাচনকালে দায়িত্বে ছিল নির্বাচন কমিশন, জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া আরও কারা কারা এ নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের শনাক্ত করা হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, ওই নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমন দিনের ভোট আগের রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব অভিযোগ জমা হয়েছে দুদকে।
কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য একটি টিম গঠন করেছে। অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও, দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ এবং নির্বাচনের ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে অনুসন্ধান টিম প্রতিবেদন দাখিল করবে।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছে ২৫৭টি আসন। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পায় মাত্র সাতটি আসন। ওই নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে?
একাদশ নির্বাচন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন দায়িত্ব পালন করে।
কমিশনের সদস্যরা হলেন- রফিকুল ইসলাম, মাহবুব তালুকদার, কবিতা খানম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ওই নির্বাচন কমিশন ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিরোধীরা সে নির্বাচনের নাম দেয় ‘নিশিরাতের নির্বাচন’।
অভিযোগে বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সম্পৃক্ত রয়েছে।
যেমন পুলিশের আইজি জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজি শহিদুল হক, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটানিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিইজি, পুলিশ সুপার, থানার ওসি, জেলা-উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়।
আওয়ামী লীগের সরকার ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।