শ্রমজীবী মানুষকে অধিকার বঞ্চিত রেখে বিজয়ের সুফল পাওয়া যাবে না : অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেছেন, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পেরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা আত্মপ্রকাশ করেছি। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়। অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম ও শহীদের লাশের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের কৃষক, মজুরসহ সর্বস্তরের শ্রমিকরা মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। গরীব মেহনতি শ্রমিকরা নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অঙ্কিত করেছে বাংলাদেশের পতাকা।
তিনি আজ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন কর্তৃৃক মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে উপরিউক্ত কথা বলেন। ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী, লস্কর মুহাম্মদ তসলিম, কবির আহমাদ, কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, কোষাধ্যক্ষ আজহারুল ইসলাম। এই সময় আরও উপস্থিত ছিলেন দপ্তর সম্পাদক নুরুল আমিনসহ ফেডারেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশের অবস্থা ছিল শোচনীয়। দেশের পথঘাট ছিল বিধ্বস্ত। সেখান থেকে দেশকে উত্তোরণের জন্য শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে গিয়েছে দিনরাত। তাদের সেই অমানুষিক পরিশ্রম ও খাটুনির বদৌলতে আজকের বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকের পরিশ্রমের দ্বারা দেশে একের পর এক নগরী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি শূণ্য থেকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যাদের হাত ধরে সেদিনের বাংলাদেশ আজকের রূপ পেয়েছে সেই শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। স্বধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এইদেশের মেহনতি গরিব শ্রমিকদের দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরও শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি স্কেল প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তিনি বলেন, দেশে সরকার আসে আবার চলে যায়। প্রতিটি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে দুর্নীতি, দুঃশাসন জড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ক্রমগত জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও গরিব মেহনতি শ্রমিকদের দারিদ্র ও ক্ষুধার সাথে লড়তে হচ্ছে। বিপদে-আপদে মালিক কিংবা রাষ্ট্রের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও শ্রমিকরা একটু সহযোগিতা পায় না। করোনার এই কঠিন সময়ে শ্রমিকদের অসহায়ত্ব সারাদেশের মানুষ দেখেছে। শ্রমিকরা বুঝেছে মালিকরা কিভাবে তাদের শোষণ করে। সরকার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মালিকদের ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিলেও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেয়নি। বরং ফটোসেশনের জন্য নামাকাওয়াস্তে কিছু শ্রমিককে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে প্রতারণা করেছে লাখো শ্রমিকের সাথে। ফলে করোনার দীর্ঘ সময়ে কর্ম হারিয়ে সন্তান সন্ততি নিয়ে অসংখ্য শ্রমিককে অনাহারে কাটাতে হয়েছে।
অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেন, শ্রমজীবী মানুষকে অধিকার বঞ্চিত রেখে বিজয়ের সুফল পাওয়া যাবে না। শ্রমিকের ঘরে বিজয়ের সুফল পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে হবে। যে রাষ্ট্র শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে থাকবে সদা তৎপর। যে রাষ্ট্র দেখবে না শ্রমিক কোন গোত্রের বা কোন ধর্মের। শ্রমিকের পরিশ্রম হবে সেখানে মুখ্য পরিচয়। যে রাষ্ট্র শ্রমিকের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে কুন্ঠাবোধ করবে না। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিককে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। পঙ্গুত্ববরণকারী শ্রমিকের পরিবারের দায়িত্ব নিবে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে ন্যায় এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। এই রকম একটি কল্যাণমুখি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি অসম্ভব।