ঢাকায় রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাত অনেকটা আতঙ্কে কেটেছে রাজধানীবাসীর। রাত ৮টার দিকে ধানমন্ডির শংকরে একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়া সেখানে আতঙ্ক তৈরি হয়। পরে বনশ্রী এলাকায় ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার ও টাকা ছিনতাই করে অস্ত্রধারীরা।
গোড়ানে একজনকে কুপিয়ে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। রাত ১টার দিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনা নিয়ে রাত ৩টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ধানমন্ডিতে যা ঘটে
রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ধানমন্ডির শংকর আলী হোসেন বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ১০ থেকে ১২ জনের একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা মসজিদে মাইকে ঘোষণা দেন যে, মহল্লায় ডাকাতদল প্রবেশ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দলটি আশপাশের দোকানগুলোতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছিল। আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা দ্রুত দোকান বন্ধ করে দেন এবং সাধারণ মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যান। প্রায় পাঁচ-দশ মিনিট অবস্থান করার পর সশস্ত্র দলটি এলাকা ত্যাগ করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এলাকাবাসী নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহযোগিতা চান। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ডিএমপি ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় কয়েকটি মোটরসাইকেলে ১৫-২০ জন তরুণ আসে। তবে তাদের হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ১৫-২০ জন তরুণ ধানমন্ডির শংকর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় হাজী ইউসুফ হাইস্কুলের পাশের গলির মুখে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়ান। এ সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। এটা দেখে পাশের কোন ব্যক্তি মসজিদের মুয়াজ্জিনকে বলেন এখানে ডাকাত এসেছে। তারপরে সে নিজের মতো করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়। এরপরই ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে। সেখানে দেখতে পায় এসব তরুণদের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র নেই। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যান।
বনশ্রীতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি
রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী ডি ব্লক ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে আনোয়ার হোসেন (৪৩) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার কাছে থাকা প্রায় ২০০ ভরি স্বর্ণ ও নগদ এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় অস্ত্রধারীরা।
পাশের ভবন থেকে ছিনতাই ও গুলির দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করেন বাসিন্দারা। রাতেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে ব্যবসায়ী আনোয়ারের কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি ব্যাগ ছাড়ছেন না। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একজন তাকে গুলি করেন। পরে ব্যাগ ছিনিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায় তারা।
গুলিবিদ্ধ আনোয়ারের স্বজনরা জানান, আনোয়ারের ব্যাগে ২০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ এক লাখ টাকা ছিল। তাদের ধারণা দোকান থেকেই তাকে অনুসরণ করেছিল দুর্বৃত্তরা। এরপর বাসার সামনে পৌঁছামাত্র স্বর্ণ ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মশিউল আলম বলেন, গুলিবিদ্ধ আনোয়ারকে প্রথমে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, আনোয়ারের শরীরে চারটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এছাড়া অন্তত ৬ স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে।
ঢাবিতে বিক্ষোভ
বনশ্রী ও মোহাম্মদপুরে দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাত ১টা ১০ মিনিটে তাৎক্ষণিক হল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতির প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভে তারা ‘জুলাইয়ের রক্তের দাম চাই, নিরাপদ দেশ চাই’, ‘সারা দেশে অপরাধ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘এক দুই তিন চার, জাহাঙ্গীর গদি ছাড়’, ‘দফা এক দাবি এক, জাহাঙ্গীরের পদত্যাগ’, ‘মা বোনদের নিরাপত্তা দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকটি বড় অপরাধের ঘটনা সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এগুলো প্রতিরোধে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। আজও মোহাম্মদপুর, বনশ্রী, ধানমন্ডিতে ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের উপদ্রব ছিল। কেউ বাসা থেকে বের হতে নিরাপদবোধ করছেন না, মানুষ আতঙ্কবোধ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার জরুরি সংবাদ সম্মেলন
রাত ৩টার দিকে বারিধারার ডিওএইচএসে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে। তারা প্রচুর টাকা দেশ থেকে স্থানান্তর করেছে। এখন সেই টাকা ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আমরা এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেব না। আমরা যেভাবেই হোক এটা প্রতিহত করব। দিনে-রাতে যেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজন হবে, তারা সেখানে যাবে এবং প্রতিহত করবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আগামীকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়বে। যেখানেই ঘটনা ঘটবে সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য প্রচুর টাকা ব্যবহার করছে। তবে আমরা শক্ত হাতে তাদের প্রতিহত করব। আওয়ামী লীগের যারা এসব কাজ করছে, তাদের ঘুম হারাম করে দেব।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ দিনে-রাতে কোথাও জায়গা পাবে না। আমরা টহল টিমকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি। তারা যদি কাজ করতে না পারে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, এই আওয়ামী দোসর যারা এই কাজগুলো করছে, তাদের ঘুম হারাম করে দেব।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকেছি। এখন আমরা নির্ধারণ করব কীভাবে কী করা যায়। আগামীকাল থেকে আপনারা সুনির্দিষ্ট উন্নতি দেখবেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বাসার সামনে হাসনাত
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার জরুরি সংবাদ সম্মেলনের পরপরই তার বারিধারা ডিওএইচএসের বাসায় সামনে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এ সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে এ সময় ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে রাজি হননি।