চলতি মাসেই যুগ্মসচিব পদোন্নতি পাচ্ছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা। তাদের পদোন্নতি দিতে সুপিরিয়ার সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) কয়েকটি সভা সম্পন্ন করেছে।
পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শুক্রবার বিকেলে এসএসবির বৈঠকের মাধ্যমে যুগ্মসচিব পদোন্নতির তালিকা চূড়ান্ত হতে পারে।
চলতি মাসে অথবা ঈদের পরেই পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই পদোন্নতির জন্য তদবিরে এগিয়ে রয়েছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের একান্ত সচিব এবং সেই সময়ের শেখ হাসিনার আস্থাভাজন জেলা প্রশাসকরা। সরকারের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং কয়েকজন সচিব তাদের পদোন্নতির পক্ষে জনপ্রশাসনে তদবির করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের একান্ত সচিব এবং জেলা প্রশাসকরা।
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে অনেকেই আবারও একান্ত সচিব পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন। এখন তারা যুগ্মসচিব পদোন্নতি পেতে উপদেষ্টাদের মাধ্যমে তদবরি করছেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন।
এরপর ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ সময় আস্থার সাথে শেখ হাসিনার দায়িত্ব পালন করায় তাকে উপহারস্বরুপ ২০২১ সালে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমন চিহিৃত আওয়ামীপন্থী সুবিধাভোগী কর্মকর্তা এখন যুগ্মসচিব পদোন্নতি পেতে জোর তদবির করে পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বর্তমান স্থানীয় সরকার বিষয়ক উপদেষ্টা এ এফ এম হাসান আরিফ-এর একান্ত সচিব হয়েছিলেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। হাসান আরিফের মৃত্যুর পর এই কর্মকর্তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ঐ ব্যাচের সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী মির্জা আজমের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তাও যুগ্মসচিব পদোন্নতির জন্য জোর তদবির চালাচ্ছেন।
এসকল কর্মকর্তা ছাড়াও যুগ্মসচিব পদোন্নতির জন্য ভোল পাল্টে ছাত্র-জনতার কাতারে দাড়িয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও সমন্বয়কদের আশির্বাদ নিয়ে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসকল কর্মকর্তাদের মধ্যে গোপালগঞ্জে অধিবাসী হওয়ায় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে ঢাকা এবং গাজীপুরের মতো জেলার জেলা প্রশাসক হয়েছিলেন আনিসুর রহমান। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, গাজীপুরের কাপাসিয়ার ইউএনও, শিল্প মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন।
শিক্ষা উপমন্ত্রীর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের একান্ত সচিব ছিলেন শাহগীর আলম। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হওয়ায় এই কর্মকর্তাকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির একান্ত সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয় এই কর্মকর্তাকে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ছিলেন মো. জহুরুল ইসলাম। এর আগে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তাকে তার কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে পদায়ন করেছিলেন। এর আগে ঐ কর্মকর্তা আশ্রয়ন প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এবং কৃষি মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন খন্দকার ইয়াসির আরেফিন।
এই কর্মকর্তাকে প্রথমে নীলফামারির জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়। কিন্তু এটি ছোট জেলায় হওয়ায় তার পছন্দ ছিলনা। এজন্য পরবর্তীতে তাকে খুলনার জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা আওয়ামী লীগ সরকার। এর আগে তিনি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সচিব, গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন গওহর রিজভী। সরকারের দাপুটে এই উপদেষ্টার দীর্ঘ ১০ বছরের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ আল আমীন যুগ্মসচিব পদোন্নতিতে তদবিরে এগিয়ে রয়েছেন।
সম্প্রতি রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ শফিউল আরিফকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব থাকাকালে এই কর্মকর্তার প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই মোহাম্মদ সাইদুল আরীফকে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করেন।
এছাড়াও পদোন্নতিতে তদবিরে এগিয়ে রয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পিএস ও নোয়াখালীর ডিসি দেওয়ান মাহবুবুর রহমান, নওগার সাবেক ডিসি খালিদ মেহেদী হাসান, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিএস ও চাঁদপুরের সাবেক ডিসি কামরুল হাসান, শেরপুরের সাবেক ডিসি সাহেলা আক্তার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপপ্রকল্প পরিচালক ও পিরোজপুরের সাবেক ডিসি মো. জাহিদুর রহমান, পরিকল্পনামন্ত্রীর পিএস ও সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি মো. হুমায়ুন কবির, পটুয়াখালীর সাবেক ডিসি মো. কামাল হোসেন এবং জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ ও ইউসুফ হারুনের পিএস এবং নাটোর ও রাজশাহীর ডিসি শামীম আহমেদ, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর পিএস হেমন্ত হেনরী কুবি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের পিএস গোলাম মওলা, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পিএস নুর আলম, বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর পিএস মো. আ: জলিল।
বিএনপির এক নেতার সুপারিশে মেয়র তাপসের পিএস এবং মাদারীপুরের সাবেক ডিসি মারুফুর রশিদ খান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একজন সচিবের তদবিরে শেখ হাসিনার কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক মো: মনিরুজ্জামান, ফ্যাসিস্ট সরকারের সচিব ও এসএসবির সদস্যের সুপারিশে ইকতিদার হাসান ও মো. হেলাল উদ্দীন, একজন সমন্বয়কের সুপারিশে সাবেক আইন সচিব পিস্তল দুলালের পিএস ও ঢাকার ডিসি তানভীর আহমেদ এবং বগুড়া বাড়ী সূত্রে নসরুল হামিদের পিএস রোকন উল হাসান এবং অপর পিএস আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান, নৌ-পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর পিএস মোহাম্মদ আরবাউল হাসান মজুমদার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের পিএস মোহাম্মদ মিকাইল পদোন্নতি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যুগ্মসচিব পদোন্নতির তালিকায় অনেকেই ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর পিএস ও বৈদেশিক মিশনে আওয়ামী পরিচয়ে সুবিধাভোগী হিসেবে কর্মরত ছিল এমন কর্মকর্তারাও রয়েছে।
এসএসবি’র সভায় ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসনের পাঠানো কর্মকর্তাদের তথ্য যাচাই বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এই তালিকায় স্বৈরাচারীর সুবিধাভোগী এবং জুলাই আন্দোলনের বিষয়ে কটূক্তিকারী কর্মকর্তাদের রাখা হলে আন্দোলনে শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে।