শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত ছিল তার প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে একটু ধারণা থাকতে হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ যুদ্ধের ক্ষতে চূর্ণ-বিচূর্ণ। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিবের আগমনে দেশের জনগণ আবেগ আর উল্লাসে আপ্লূত হয়ে পড়ে। মেজর ফারুক এ দিনটা নিয়ে বলেছিলেন-
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসায় আমরা (সেনাসদস্যরা) আবেগে কেঁদে দিয়েছিলাম।
কিন্তু স্বপ্নের বুদবুদ বেসামাল হয়ে পড়ে। সবার কেবল এক কথা- “দেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেক যুদ্ধ করেছি। এবার কেবল চাই। গাড়ি চাই, বাড়ি চাই, টাকা চাই, চাকরি চাই। অথচ দেয়ার কেউ নেই।”
যুদ্ধের পর আমরা বাঙালিরা কাজ না করেই ফল লাভের জন্য অত্যুৎসাহী হয়ে পড়ি। ভালোবাসার নেতা শেখ মুজিব থেকে অনেক বেশি কিছু আশা করে অবশেষে স্বপ্নভঙ্গ হয় বাঙালিদের।
এদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুও দেশ শাসনে বেশ কিছু ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্বজনপ্রীতি, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর হম্বিতম্বিতে জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আবার সমাজতান্ত্রিক কায়েমের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শুরু করে অগোছালো রক্তাক্ত সংগ্রাম। আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। তৈরি করেন মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন বেসামরিক সদস্যদের নিয়ে এক মিলিশিয়া বাহিনী। এর নাম দেন “রক্ষীবাহিনী”। আর এটাই হয়ে পড়ে মরণফাঁদ। রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদের চরম আধুনিকায়ন, উন্নত প্রশিক্ষণ আর সুযোগ সুবিধার জন্যে একে অনেকে “সেনাবাহিনীর বিকল্প” বলে অভিহিত করেন। স্বভাবতই, সেনাবাহিনীর জন্য খরচ কমিয়ে এরকম একটা মিলিশিয়া বাহিনীর আধুনিকায়ন অনেক সেনা কর্মকর্তা মেনে নিতে পারেননি। তাছাড়া, রক্ষীবাহিনী আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে তো আনেনি, বরং গুম, হত্যা ও জনসাধারণের উপর অত্যাচার করে বিতর্কের জন্ম দেয়।
শেখ মুজিব সবকিছু ঠিক করার শেষ চেষ্টা হিসেবে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক “বাকশাল” ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু একটা ব্যাপারটাতে একটা বড় ফাঁক রয়ে যায়। অন্য সব রাজনৈতিক দলকে বাকশালে যোগ দিতে বলা হয়, অন্যথায় তাদের বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সমাজতান্ত্রিক দল ও ইসলামিক দল বাকশালে যোগ দেয়ার বিরোধিতা করে। যদিও আদর্শগত ভাবে এসব দল পরষ্পরবিরোধী, তবু মুজিব বিরোধিতায় এরা একত্রে মেতে ওঠে। বাংলাদেশবিরোধী “জামায়াতে ইসলামী”ও নতুন করে শুরু করে রাষ্ট্র ও মুজিববিরোধী ষড়যন্ত্র।
তবে মুজিব হত্যার মূল চালটা আসে সেনাবাহিনী থেকে। আগেই বলেছি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুজিবের উপর অসন্তুষ্ট ছিল রক্ষীবাহিনী নিয়ে। এখন আবার বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ হল- “মুজিব আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকবেন এবং সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দিবেন”
যে যাই বলুক না কেন, মূলত এই কারণটাই মেজর ফারুককে প্রচণ্ড ভাবায়। দেশের পরিস্থিতি বেহাল দেখে ফারুক সিদ্ধান্ত নেয়- মুজিবকে হত্যা করতে হবে। এ কাজে সে সাহায্য নেয় তার ভায়রা ভাই মেজর রশিদের। মূল পরিকল্পনা তারা কাউকেই জানায় না। ছলেবলে ধীরে ধীরে আরো কিছু অফিসারকে তারা দলে ভিড়ায়। যেসব অফিসারের সাথে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল, তাদেরকে নিয়ে মেজর ফারুক-রশিদ গং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
চিত্রঃ মেজর রশিদ
চিত্রঃ মেজর ফারুক
মেজর রশিদ উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সাথে মুজিব হত্যার ব্যাপারে সাহায্য চাইলে জিয়া বলেন-
আমি একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে এ ধরনের ঘটনায় নিজেকে জড়াতে চাই না, তবে তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি এ কাজটি করতে চাও, তবে চালিয়ে যাও।
মুজিব হত্যার পর রাজনৈতিক অভাব পূরণের লক্ষ্যে মেজর রশিদ তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে। মোশতাক তাদের পরিকল্পনায় সম্মতি প্রদান করে এবং মুজিব হত্যার পর রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে রাজি হয়।
মোশতাকের সাথে আমেরিকান অ্যাম্বাসির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মোশতাক আমেরিকার সাথে আঁতাত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বানচালের চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টার মুজিব হত্যার পরিকল্পনা জানতেন বলে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ দাবি করেন। লরেন্স আরো বলেন- মুজিব হত্যা ঢাকায় সি আই এর স্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী মুজিব হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছেন। তার প্রমান পাওয়া যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মুজিব হত্যার পর যখন পুরো শহর খাঁ খাঁ করছে আতঙ্কে, তখন আমেরিকার পতাকা পতপত করে উড়িয়ে দূতাবাসের গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়।
অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, একদল সেনা সদস্যদের হাতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু সপরিবারে প্রাণ হারান।
চিত্রঃ সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়া বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ।
এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল সেনাবাহিনীর কেবল দুটো ইউনিটের সৈন্য, যারা তাদের কমান্ডার ফারুক ও রশিদের কথা শুনতে বাধ্য ছিল। পুরো সেনাবাহিনীর আর কেউ এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানত না। (জিয়াউর রহমান ও শাফায়াত জামিল বাদে, শাফায়াত জামিলও এ হত্যার ব্যাপারে আগে থেকেই জানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়)
আর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল মেজর ফারুক ও রশিদের নেতৃত্বে হাতেগোনা কয়েকজন জুনিয়র অফিসার, যেমন- মেজর ডালিম, মহিউদ্দিন, বজলুল হুদা, মেজর নূর প্রমুখ। রাজনৈতিক অঙ্গনে খন্দকার মোশতাক এবং সম্ভবত আমেরিকান দূতাবাস শেখ মুজিব হত্যার সাথে জড়িত ছিল।