ইতিহাসে যে কজন ব্যক্তিত্ব তাদের কীর্তিতে আজীবন মানুষের মনের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছেন। পৃথিবী থেকে চলে গেলেও এখনো তাঁরা জীবিত। কেবল নামই নয়, বরং নামের সাথে তাদের চরিত্র ও গুণাবলীরও ফুঠে উঠে।সেসব স্বরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) অন্যতম।১৯৩১ সালের ১লা মার্চ চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উত্তর হাইদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ সেকান্দর মাস্টার। প্রাইমারী শিক্ষা শেষে তিনি চট্টগ্রামের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাজেম আলী হাইস্কুল থেকে দশম শ্রেণী পাস করে মিরসরাই সুফিয়া নুরীয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে আলিম-ফাজিল এবং ছারছিনা আলিয়া মাদরাসা থেকে প্রথম শ্রেণীতে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে কামিল পাস করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম ষোলশহরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের সোবহানিয়া আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিসসহ বিভিন্ন পদে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট জামে মসজিদ ও রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদে দীর্ঘ দিন খতিব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল পর্যন্ত দ্বীন চর্চা, দ্বীন প্রচার এবং শিক্ষার প্রসারে তিনি ছিলেন এক অনন্য মহান পুরুষ।
মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) শুধু একজন ব্যক্তি নন। বরং তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি একটি আনজুমান, একটি একাডেমী, একটি গবেষণা ইনষ্টিটিউটও বঠে। তিনি ছিলেন বড় অন্তরের অধিকারী ও মধ্যমপন্থী আলেমে দ্বীন। উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহৃদয়তার মতো গুণের কারণে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ তাঁর কাছে বিদ্যমান ছিল । তিনি একজন প্রচার বিমুখ দক্ষ সংগঠক ছিলেন। ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ১৯৭৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ বছর নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুদ মুক্ত সমাজ গড়তে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠায় বায়তুশ শরফের মরহুম পীর অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ:)’র সাথে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ডাইরেক্টর ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান,শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইনস্টিটিউট, আল জাবের ইনস্টিটিউট, জামান আনোয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ সহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম ডেন্টাল (প্রাইভেট) কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তারই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠিত এবং দৈনিক কর্ণফুলী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এমনকি তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটির সহসভাপতি, জিলা চাঁদ দেখা কমিটির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়বেটিক অ্যাসোসিয়েসনের আজীবন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘ দিন চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসার সহ-সভাপতি ছিলেন।
মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) উত্তম আদর্শ ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নম্রতা ও বিনয়বনতা, দানশীলতা, তাকওয়া ও পরহেজগারী এবং আশেকানে রাসূল প্রভৃতি গুণাবলীতে তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। তিনি বিশিষ্ট সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনহিতকর ও সমাজসেবামূলক কাজ সম্পাদন করেন। এলাকার মানুষের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা ছিলেন। তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত মানুষ ও মানবতার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন। তিনি অন্যের দুঃখে বৃথিত আর অন্যের সুখে তৃপ্তি অনুভব করতেন।
মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) ১৯৫৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক ২ (দুই) ছেলে ৪ (চার) কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। বড় ছেলে এ. এম. এম. আনাস অপর ছেলে মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, হান্না উম্মে মরিয়ম স্বামী আব্দুল গফ্ফার, মুহছেনা বেগম স্বামী মাওলানা মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ, আছমা বেগম স্বামী সৈয়দ মুহাম্মদ মুজিবুল হক, হুমায়রা আফরোজ স্বামী মহিউদ্দীন আল ফারুক।
কোরআন-সুন্নাহর সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কায়েমে মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (রহ) ছিলেন পথপ্রদর্শক এবং একনিষ্ঠ কর্মী।ভিতরে বাহিরে ইলম আমল আর সাহসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর সংগ্রামী জীবনের সবচেয়ে সফল আপোষহীন এক মাইল ফলক।
২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারী তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। পরদিন চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড ময়দানে নামাজে জানাজায় লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। তিনি এ দেশের মানুষের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।আল্লাহ পাক তাঁকে আন্বিয়া, সোলাহা ও শুহাদার সাথে জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা ইল্লিয়িনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান নসীব করুন। আর আসুন আমরা এই মহান আলেমের অনুপম চারিত্রিক ও আদর্শ অনুসরণ করে দ্বীনের খেদমতে নিজেদের নিয়োজিত করি।
লেখক: কলামিস্ট।
প্রচার ও প্রকাশনা সচিব, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।