ভার্সিটি যাবার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম । হঠাৎ সায়েম আঙ্কেল পথ আটকে বললেন,
– তোমার নাম কি ?
আমি সহাস্যে উত্তর দিলাম, শুভ ।
– আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে । পড়াতে পারবে ?
– জ্বি পারবো ।
– ঠিক আছে কাল থেকে এসো ।
কথাটা বলেই উনি চলে যাচ্ছিলেন । আমি বললাম, বেতনের কথাটা ঠিক করে নিলে হয়না ?
উনি আমার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বললেন, ভয় পেয়ো না । আমার স্ত্রী বলেছে তোমার কথা । তোমার সাথে নাকি এর আগে একদিন কথা হয়েছিলো !
আমি বুঝতে পারলাম রেবেকা আন্টি বলেছে । সায়েম আঙ্কেল সরকারি কর্মকর্তা, একই ফ্ল্যাটে থাকি তাই উনি না চিনলেও আমি চিনতাম ।
আজ পড়ানোর প্রথম দিন । আমি রিডিং রুমে বসে আছি । একজন কে নাস্তা আনতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলাম । আন্টি নিজেই নাস্তা নিয়ে এসেছেন ।
– আন্টি আমার স্টুডেন্ট কোথায় ? অনেকক্ষণ হলো বসে আছি ।
– তুমি বসো বাবা । আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ।
আচ্ছা ঠিক আছে, কথাটা বলেই আমি দেয়ালের পেইন্টিং গুলো দেখছিলাম । কি সুন্দর করে আঁকা ! মনে হচ্ছিল পাবলো পিকাসো একসময় থাকতেন এখানে ।
– আসসালামুয়ালাইকুম ।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম, বসো ।
– আপনি কি পেইন্টিং গুলো দেখছিলেন ? ওগুলো আমার আঁকা ।
কথাটা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ । ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা মেয়ের হ্যান্ড পেইন্টিং এত কড়া লেভেলের সুন্দর হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না ।
আমার স্টুডেন্টের নাম রিয়া । পরিচয় পর্ব শেষ করে সেদিনের মতো চলে আসলাম । আমি ভেবেছিলাম যার পেইন্টিং এত সুন্দর সে নিশ্চয়ই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ।
কিন্তু আমার ভাবনায় তা একদমই ভুল ছিলো । ওকে পড়াতে গিয়ে বুঝলাম পড়াশোনা তার একেবারেই ভাল্লাগে না । পড়াশোনা বাদে পৃথিবীর সকল কাজের কাজি সে । এত চঞ্চল আর বাচাল টাইপের মেয়ে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি ।
একদিন পড়াতে গিয়ে যদি দেখি ও ফুচকা বানাচ্ছে, তো আরেকদিন আইসক্রিমের রেসিপি নিয়ে গবেষণা করছে । আজ পর্যন্ত এমন একটা দিনও পাইনি যেদিন গিয়ে দেখেছি ও পড়াশোনা করছে ।
আমার যেমন খুব বিরক্ত লাগতো, তেমন হাসিও আসতো । যতদূর বুঝতাম পড়াশোনা টা ওর জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো তাই মনের বিরুদ্ধেই পড়াশোনা করতে হতো ।
আজ বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে ।
ভাবলাম পড়াতে যাবোনা, ভিজবো । যেই ভাবা সেই কাজ । একদৌড়ে চলে গেলাম ছাদে । গিয়ে দেখি রিয়া বৃষ্টিতে ভিজছে । ওখানে থাকবো কিনা বুঝতে পারছি না । পরে ভাবলাম স্টুডেন্টের সাথে যদি কেউ বৃষ্টি ভেজা দেখে তাহলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে ।
পরের দিন পড়াতে গিয়ে শুনি ওর ঠান্ডা জ্বর । সেদিন আর পড়ানো হয়নি ।
এভাবে কেটে গেলো কয়েকটা মাস । আঙ্কেল আমাকে মোটা অঙ্কের বেতন দিতেন, আর বিশ্বাসও করতেন খুব।
একদিন আন্টি ফোন দিয়ে বললেন,
– শুভ তুমি কি ফ্রি আছো ? রিয়াকে নিয়ে একটু মেলায় ঘুরে আসতে পারবে ? এত্ত বায়না ধরে এই মেয়েটা ! যুগ খারাপ, অন্য কারো সাথে গেলে তোমার আঙ্কেল খুব রাগ করবেন ।
– ঠিক আছে আন্টি আমি আসছি ।
ফোনটা রেখে রেডি হতে শুরু করলাম । খুব একটা ইচ্ছে নেই তবুও যেতে হবে । কারণ মাস গেলে খরচের টাকাটা এখান থেকেই আসে ।
কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো যেন এই শব্দটার জন্যই কেউ অপেক্ষা করেছিলো । রিয়াকে দেখেই একটা বড় ধরণের শকড্ খেলাম ।
নীল শাড়ি, খোঁপায় ফুল, চোখে কাজল আর হাতের চুড়ি- সব মিলিয়ে ওকে অনেক সুন্দর আর মায়াবী লাগছিলো ।
মেলায় পাশাপাশি হাঁটছি । একটা ছেলে এসে বললো, “ভাই ভাবিকে নিয়ে দাঁড়ান একটা ছবি তুলে দেই ।”
আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম । এমন অভিজ্ঞতা আর কারো জীবনে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই । রিয়া মুচকি হাসছে ।
একটু পর খেয়াল করলাম ওর দিকে সবাই এমন ভাবে তাকাচ্ছে, আমার কেমন যেন খুব রাগ হচ্ছিলো ওদের উপর ।
রিয়া বললো, শুভদা ফুচকা খাবো ।
কথা টা শুনে আমি থ’ হয়ে গেলাম । এই প্রথম ও আমার নাম ধরে বললো । সবসময় স্যার বলে । আর হঠাৎ শুভদা!
ফুচকা খাওয়ানো শেষ হতেই আবদারের ফোয়ারা ছুটলো । চকলেট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস আর এটা ওটা কেনা । আজ আমার পকেট শেষ ।
বাড়ি ফিরতেই আন্টি ওকে খুব বকা দিলো কেনাকাটা দেখে । আমি বুঝিয়ে রুমে চলে আসলাম ।
আসার পর থেকে বুকের ভেতর কি যেন একটা শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম । কিন্তু আমার ভুলে গেলে চলবে না যে আমি ওর টিচার ।
ঘুম থেকে উঠলাম কলিংবেলের শব্দে । উফফফফ্ কি অসহ্য ! দরজা খুলতেই দেখি গণিত বই হাতে রিয়া ।
– আরে বাহ্ ! কোনদিন তো পড়াশোনার প্রতি এত আগ্রহ দেখিনি । আজ হঠাৎ বই হাতে ?
– ইচ্ছে হলো শুভদা ! আর তো মাত্র দুইদিন । তারপর এ পাড়া থেকে চলে যাবো ।
মুখ গম্ভীর করে উত্তর দিলো রিয়া । আমার নিজের কাছেও খটকা লাগছে কেমন যেন । আন্টি তো আমাকে কিছু বলেননি, তাহলে কি হলো হঠাৎ করে !
– শুভ দা আসি । বিকেলে পড়াতে এসো ।
কথাটা বলে ও এক সেকেন্ডও দেরি করলো না ।
আমি তখনই আন্টিকে ফোন দিলাম কি হয়েছে জানার জন্য । তবে যেটা শুনলাম তা শোনার কোন ইচ্ছে আমার ছিলোনা ।
আন্টি বললেন,
– তোমার আঙ্কেলের ট্রান্সফার হয়েছে । আমরা পরশুদিন এখান থেকে চলে যাবো । তুমি বিকেলে এসে টাকাটা নিয়ে যেও ।
হাত থেকে ফোন টা পড়ে গেলো । আজ সত্যিই খুব শূন্যতা অনুভব করছি । কথাটা শোনার পর মনে হলো সময় আমার সঙ্গে নেই । শেষ দুইদিন পড়াতে গিয়ে বুঝলাম আমার প্রতি রিয়ার অনুভূতিও আসলে অন্য কিছু । কিন্তু আমার তো কোন উপায় ছিলো না ।
ফোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটলো । আমার স্ত্রী রাবেয়া ফোন করেছে ।
– বাসায় ফিরবে কখন ? গেস্ট রা তো সবাই এসে গেছে ।
– আমি আসছি ।
ফোন টা রেখে দিলাম ।
আজ আমার মেয়ে মুনতাহার জন্মদিন । ঘরোয়া পরিবেশে ছোট আয়োজন । অফিসের ইমারজেন্সি একটা মিটিং-এর জন্য আমার দেরি হয়ে গিয়েছে ।
সেদিনের পর রিয়ার সাথে আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি । অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি ।
অন্য ৫-১০ টা ছেলের মতো আমিও পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরি করছি । বিয়েও করেছি, একটা মেয়ে আছে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে ।
আমার স্ত্রীর মধ্যেও রিয়াকে খোঁজার চেষ্টা করতাম প্রথম প্রথম । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই পৃথিবীতে কেউ কারো মতো হয়না, সবাই যার যার দিক থেকে পারফেক্ট ।
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় চলে আসলাম । কেক কাটতে কাটতে অনেক দেরি হয়ে গেলো । এতরাত হবে আমি ভাবতে পারিনি ।
গিয়ে দেখি মুনতাহার কয়েকটা বন্ধুও এসেছে । কেউ বাবার সঙ্গে এসেছে, কেউবা মায়ের সঙ্গে ।
একটু অদূরে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি কাছে গিয়ে বললাম,
– কি হয়েছে মা ? তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন ?
– বাসায় গেলে আম্মু বকা দিবে ।
বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো । এর মধ্যেই রাবেয়া এসে বললো,
– তুমি বরং ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসো । এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি ।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । বাসায় পৌঁছে দিতে হবে মেয়েটাকে । আমার জন্যই এতকিছু হলো ।
– ভয় পেয়ো না বাবু । কিছু হবেনা ।
– আম্মু বকা দিবে ।
ওর এই একই কথা শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছে । সামান্য দূরত্বে বাসা । কি ভয়টাই না জানি পেয়েছে মেয়েটা ! রাস্তায় ওকে কিছু চকোলেটস্ কিনে দিলাম । দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম ।
কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেলো । দরজা খুলতেই তো আমি অবাক ! এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না । যে মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ নয়- রিয়া ।
– রিয়া !
– কেমন আছো শুভ দা ? অনেকদিন পর দেখা তাইনা ? ভেতরে এসে বসো। এত দেরি হলো কেন মুনতাহা ?
আরে এই মেয়েটার নাম মুনতাহা ! আমি বেশ অবাক হয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকালাম, ভুল করে আমার মেয়েকে নিয়ে আসিনি তো !
একে তো রিয়াকে দেখে আমার হুঁশ উড়ে গেছে, তার উপর বাচ্চাটার নাম মুনতাহা ।
– তুমি অনেক বদলে গেছো শুভ দা । আগের সাথে কোন মিল নেই তোমার । আচ্ছা বসো চা নিয়ে আসি ।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, মেয়েকে আনতে গেলে না কেন ? এত রাত হয়েছে তবুও খোঁজ নিলে না ?
– যদি অন্য কোথাও যেত তবে যেতে দিতাম না । দিলেও সঙ্গে যেতাম । কিন্তু আমি জানি তোমার মেয়ের জন্মদিন । তাই নিশ্চিন্তে ছিলাম যে মেয়ে ফিরে আসবে। অবশ্য একটু আগে থেকে সামান্য টেনশন শুরু হয়েছে ।
আমি চুপ হয়ে চা খেতে লাগলাম । বললাম,
– তুমি তো আগের মতোই আছো । সেরকমই কথার আগুন, সেরকমই বাকপন্ডিতি । মেলায় যাওয়া, ফুচকার বায়না সবকিছুই চলে এখনো ?
– না শুভ দা । প্রিয় মানুষ ছাড়া এসবের কোন দাম নেই বুঝলে তো ! আর মা হলে তো সব ভুলেই যেতে হয় !
– মেয়েটার নাম মুনতাহা রাখলে যে ?
– একজন পড়াতে গিয়ে বলেছিলো এই নাম টা তার খুব পছন্দের । অবশ্য ওর বাবা রাখতে চায়নি, আমিই জোর করে রেখেছি ।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম, কথা বলার শক্তি নেই আর । পা বাড়িয়ে দরজায় এসে আরেকবার পিছনে তাকালাম । সবকিছু ঠিকঠাক, শুধু ওর চোখের নিচে কালো দাগ টাই স্পষ্ট হয়ে আছে ।
Post Views: 517
Like this:
Like Loading...
Related