কক্সবাজার পর্যটন শহরে প্রথম ট্রেন : উচ্ছ্বসিত সাগরপাড়ের মানুষ

কক্সবাজার: অবশেষে কক্সবাজারবাসীর স্বপ্নের রেল আসার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। বাংলাদেশ রেলওয়ের কারিগরি টিমের কর্মকর্তাসহ ট্রেন এসে পৌঁছালো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নির্মিত আইকনিক রেল স্টেশনে। পরিক্ষামূলক এই ট্রেনটি কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার নির্মাণ করা নতুন রেলপথে প্রথমবারের মতো কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে।
ট্রেন আসায় উচ্ছ্বসিত সাগরপাড়ের মানুষেরা। তারা বিকাল থেকে কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনে ভিড় করে। এ সময় সমবেত লোকজন শ্লোগানে শ্লোগানে অন্যতম এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। এছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে প্রতিটি স্টেশনে উৎসুক জনতার ভিড় জমে। এছাড়া পথে পথে সাধারণ মানুষ চলন্ত রেলগাড়ি দেখে খুশিতে মেতে উঠে।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র শহর কক্সবাজারে স্বপ্নের রেল লাইন ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। আর তারই জন্য রবিবার চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা দেয়া ট্রেন কক্সবাজার এসেছে পৌঁছেছে। রবিবার সন্ধ্যা ৬ টা ২২ মিনিটের সময় ট্রেনটি এসে পৌঁছে এশিয়ার সর্ব বৃহৎ আইকনিক রেলস্টেশন কক্সবাজারে।

মুলত উদ্বোধনের আগে প্রকল্পটি রেল চলাচলের উপযোগি কিনা তা দেখতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ট্রেনটির যাত্রা।

রবিবার (৫ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে কক্সবাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে প্রথম ট্রেনটি। রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদের নেতৃত্বে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ট্রেনে ছিলেন। ৮টি বগি সম্বলিত বিশেষ এই ট্রেনে থাকা কর্মকর্তারা যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে প্রকল্পটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আর কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের পর চূড়ান্ত অনুমোদন মিললে এই রেল লাইন ট্রেন চলাচলের উপোযোগী হিসেবে ঘোষণা করা হবে।

আগামী ১১ নভেম্বর নতুন এই রেলপথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। ৭ নভেম্বর এখানে ট্রায়াল ট্রেন চালানোর কথা ছিল। তবে পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে রেলওয়ে।

কক্সবাজার রুটের প্রথম ট্রেনটি চালিয়ে এনেছেন লোকোমাস্টার মাহফুজুর রহমান ও সহকারী লোকোমাস্টার মো. রুকন মিয়া। তারা বলেন, “কক্সবাজারের প্রথম ট্রেনে যাত্রা করার মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।”

বাংলাদেশ রেলওয়ের কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনের নবনিযুক্ত স্টেশন মাষ্টার মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, এটা কোনো ট্রায়াল ট্রেন না। নতুন রেলপথ নির্মান করা হলে সেটি যাচাই-বাছাই করতে হয়। এটি তারই অংশ। মুলত রেল লাইন ও বিভিন্ন স্টেশন নির্মাণ কাজ পরিদর্শন ও কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা তা যাচাই করতে রেলের পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তারা যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানালে বানিজ্যিক ভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক প্রকৌশলী রুহুল কাদের আজাদ রবিবার সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত রেলপথে আপাতত কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। রেলপথ সবই ঠিক আছে। সোমবারও রেলপথের আরো কিছু পরীক্ষা করা হবে। এরপর মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দেয়া হবে।

তিনি জানান নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলে রেলপথ যাচাই-বাছাই করতে হয়। এটি তারই অংশ। মুলত নির্মাণ কাজ পরিদর্শন ও কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা তা যাচাই করা হয়েছে। তবে এখনো এই রেললাইনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা সম্পুর্ন বসেনি। জনবল নিয়োগ করা হয়নি। এই কাজ করা সম্পন্ন হলেই কক্সবাজারের সাথে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বানিজ্যিক ভাবে রেল চলাচল করা যাবে।

দোহাজারী কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সুবক্তগীন জানান, রেলের পরিদর্শন দপ্তরের টিম দোহাজারী-কক্সবাজারের এই নতুন রেললাইন ও বিভিন্ন স্টেশন পরিদর্শন করে কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা যাচাই করে দেখেছেন। রেললাইনে কোন ত্রুটি দেখা যায়নি। আগামী ১১ নভেম্বর এই রেলপথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করবেন। এরপর খুব শীঘ্রই চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথে বানিজ্যিক ভাবে রেল চলাচল শুরু করা হবে। প্রকল্পটির ৯৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ রয়েছে।

এই রেললাইনটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে পারবে বলে মনে করছেন
কক্সবাজার সদর ও রামু সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল। তিনি জানান, কক্সবাজারের সাথে দেশের রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্হাপন হওয়ায় কক্সবাজারের পর্যটনের প্রসারের পাশাপাশি মৎস্য, চিংড়ি ও লবন পরিবহনের পথ সুগম হলো। এ ছাড়া এই রেলপথ চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমারের সাথে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে সংযুক্ত হবে। এতে চীনের কুনমিং পর্যন্ত রেলপথ চলে যাবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আগামিতে আরো বৃদ্ধি পাবে।

এই পথে ট্রেন যাওয়ার অন্যতম বাধা ছিল শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু। এই সেতুতে গত আগস্ট মাসে সংস্কার কাজ শুরু হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের একদল বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে। শুরুতে সেতুটি রেল চলাচলের উপযোগী করা হয়। গত শনিবার (৪ নভেম্বর) ৬৩ টন, ৭৮ টন এবং সর্বোচ্চ ভারী ৯০ টনের ইঞ্জিন পরীক্ষামূলক চালানো হয়েছে রেল সেতুতে। সফলভাবে এই কার্যক্রম শেষের পর এই রেলপথে ট্রেন চালানোতে আর বাধা রইল না।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, কালুরঘাট সেতু সংস্কারকাজ ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াকওয়ে ও ঢালাইয়ের কাজ বাকি। তবে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হতে মাসখানেক সময় লাগবে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমার সহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই রেললাইন আছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মান করা হয়েছে। এই রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা বহন করছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাকি খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকারের অগ্রাধিকার এই প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে।

প্রকল্পের আওতায় ১০০ কিলোমিটার রেললাইন ছাড়াও কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজরা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারীতে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের ‘আইকনিক’ ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটি। উদ্বোধনের আগে সবকটি স্টেশন চালু হবে না। তবে আইকনিক স্টেশনটি প্রস্তুত। ১১ নভেম্বর উদ্বোধন হলেও বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু করবে ১ ডিসেম্বর থেকে।

দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের অন্তত আটটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ার পাশাপাশি এই রেলপথ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। পাশাপাশি রেললাইনটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলেও অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

Exit mobile version