কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানি করা ওয়াজিব। এর গোশত বিতরণ করা ও খাওয়া সুন্নত। ঈদুল আজহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতের নামে। আল্লাহ তায়ালা এ দিনে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি কোরবানি করারও হুকুম দিয়েছেন— ‘সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড় ও কোরবানি দাও।’ (সুরা কাউসার: ০২)।
প্রথমে নামাজের হুকুম, তারপর কোরবানির। যেন বলা হচ্ছে— ‘নামাজের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহ তায়ালার সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কোরবানি কর।’
কোরবানি কী: ‘কোরবানি’ কুরবান শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো, নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা। পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, ‘আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের আশায় নির্দিষ্ট দিনে পশু জবাই করা’।
কোরবানির ফজিলত: যায়েদ বিন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (সাহাবিগণ) বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানির হাকিকত কী? রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটি তোমাদের পিতা আদম (আ.) -এর সুন্নত’। সাহাবিগণ বললেন, এতে আমাদের কী লাভ? নবীজি (সা.) বললেন, (কোরবানির পশুর) ‘প্রতিটি লোমের বিনিময়ে তোমাদেরকে একটি করে নেকি দেয়া হবে’। সাহাবিগণ বললেন, ভেড়ার ক্ষেত্রেও কি একই বিধান? নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, এরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেয়া হবে।’ (মেশকাত: ১/১২৯)।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি না করা : সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই মহান ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে— ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করার সামর্থ্য রাখে কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩১২৩)
কাদের ওপর ওয়াজিব? প্রত্যেক স্বাধীন, মুসলমান, মুকিম যারা কোরবানির দিনসমূহে নেসাব পরিমাণ মালের মালিক তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩৩৬)।
ওয়াজিব হওয়ার সময়: কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার সময় হলো, কোরবানির দিন। গ্রামবাসীদের জন্য সূর্যোদয়ের পর আর শহরবাসীদের জন্য ঈদের নামাজের পর। সুতরাং যে ব্যক্তি কোরবানির দিনসমূহকে এমতাবস্থায় পাবে যে, ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ তার মাঝে বিদ্যমান তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৮)।
কোরবানির নেসাব: স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) তোলা। আর টাকা-পয়সা ও অন্য বস্তুর ক্ষেত্রে নেসাব হলো, এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হওয়া। সোনা ও রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া : ১৭/৪০৫)।
কোন পশু দিয়ে কোরবানি করবেন? কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশু ছয়টি। যেমন : গরু (গাভী, ষাঁড়, বলদ) মহিষ, ভেড়া, ছাগল (খাসী, পাঠা) দুম্বা ও উট। এই ছয়প্রকার গৃহপালিত পশু কোরবানি করা জায়েজ। এছাড়া অন্য কোনো হালাল প্রাণী (হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি) কোরবানি করা জায়েয নেই। (আল-বাহরুর রায়েক: ৮/৩২৪)।
কোন পশু দ্বারা কোরবানি করা উত্তম? গরু, মহিষ, উট, ছাগল ভেড়া ও দুম্বা; এই ছয় ধরনের পশু কোরবানি করা জায়েজ। সামর্থ্য অনুযায়ী এই ছয় প্রকারের যেকোনো পশু কোরবানি করলেই কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে উত্তম হলো, হূষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি করা। প্রথমে উট বা ভেড়া তারপর গরু তারপর ছাগল। (শরহে মুখতাসারিত তহাবি: ৭/৩২৬) তবে গরুতে সাতজনে শরিক হওয়ার চেয়ে ছাগল একা কোরবানি করা উত্তম যখন মূল্য বরাবর হবে। (ফতোয়ায়ে শামী: ৯/৫৩৪)।
পশুর বয়স: গরু ও মহিষের দুই বছর, উটের পাঁচ বছর আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার এক বছরের কম হলে এর দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ হবে না। ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা মোটা তাজা হওয়ায় দেখতে যদি এক বছরের মনে হয় তাহলে ছয় মাসের ভেড়া, দুম্বাও কোরবানি করা জায়েজ। কিন্তু দেখতে যদি নাদুস-নুদুস না হয় তাহলে এগুলোও এক বছরের পূর্বে কোরবানি করা জায়েজ নেই। (ফতোয়ায়ে শামি: ৯/৫৩৪, শরহে মুখতাসারিত তহাবি: ৭/৩২৬) উল্লেখ্য, ছাগলের এক বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ নেই। (কিফায়াতুল মুফতি: ৮/১৯৬)।
কখন কোরবানি করবেন? কোরবানি করার মোট সময় তিন দিন। যেমন: ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ। এই তিন দিনের রাত ও দিনের যেকোনো সময় কোরবানি করা যাবে। (শরহে মুখতাসারিত তহাবি: ৭/৩৩৩)।
কখন করা উত্তম? কোরবানির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে কোরবানি করা বৈধ হলেও প্রথম দিনই ঈদের নামাজের পর কোরবানি করা উত্তম। অনুরূপ রাতের তুলনায় দিনে কোরবানি করা উত্তম। (খুলাসাতুল ফতোয়া: ৪/৩১১)
সাত শরিক ও বেজোড় সংখ্যা: শরিয়তের দৃষ্টিতে একটি গরু, মহিষ বা উটে সর্বোচ্চ সাত অংশীদার মিলে কোরবানি করতে পারবে। এর চেয়ে বেশি অংশীদার হলে কারো কোরবানি সহিহ হবে না। সাতের নিচে দুই-চার বা ছয় ভাগেও কোরবানি দিতে পারবে। এতে বেজোড় সংখ্যা হওয়া জরুরি নয়। (কিফায়াতুল মুফতি: ৮/১৮৭)।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কোরবানি : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার নেসাব পরিমাণ সম্পত্তি থেকে ঋণের অংশ আলাদা করার পর যদি নেসাব কমে যায় তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কিন্তু যদি ঋণের টাকা আলাদা করা সত্ত্বেও নেসাব বাকি থাকে তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (আহসানুল ফতোয়া: ৭/৫০৭)
গরিবের কোরবানি: গরিব ব্যক্তি যদি কোরবানি করার নিয়তে পশু ক্রয় করে তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। এমনকি ওই নির্দিষ্ট পশুই কোরবানি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। (কিতাবুল মাসায়েল: ২/৩০৪)।
কোরবানির সঙ্গে আকিকা: কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই সহিহ হবে। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যা: ২/৮০)।
কোরবানির সঙ্গে ওলিমা: কেউ যদি কোরবানির বড় পশু অর্থাৎ— গরু, মহিষ ও উটে ওলিমার অংশ রাখে তাহলে তা জায়েজ আছে। এতে ওলিমার কারণে কোরবানির পশুতে কোনো প্রভাব পড়বে না। (কিতাবুল মাসায়েল: ২/৩১৪)।
সন্তান ও স্ত্রীদের কোরবানি : ছোট নাবালেগ বাচ্চাদের পক্ষ থেকে পিতা কোরবানি দেয়া ওয়াজিব নয়। তবে দেয়া ভালো। অনুরূপ স্বামী তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোরবানি করা আবশ্যক নয়। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যা : ২/৮৭) নাবালেগ ছেলে যদি নেসাব পরিমাণ মালের মালিকও হয় তবুও বিশুদ্ধ মতানুসারে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। (বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৪)