আমার হুমায়ুন! পাঠকের হুমায়ুন!
হুমায়ুন আহমেদকে আমি অপছন্দই করতাম। কেননা যখন গল্প-উপন্যাস পড়ে বুঝতে শিখেছি সেই বয়সটাতেই
হুমায়ুন আহমেদ গুলতেকিনকে(বি.১৯৭৩; বিচ্ছেদ.২০০৩) ছেড়ে শাওনের(বি.২০০৫) সাথে জড়িয়ে পড়েন। বাস্তবে
যা ঘটেছিল তারচেয়ে অধিক কিছু মুখরোচক করে হুমায়ুন-শাওন সম্পর্কে প্রচারিত হওয়ায় হুমায়ুন আহমেদের
ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে এক অজানা ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে-ঠিক মেনে নিতে
পারছিলাম না বলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম হুমায়ুন আহমেদকে কখনোই পড়বো না। ঘৃণা এই পর্যায়ে ছিল যে,
কোন এক পরীক্ষায় হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস সম্পর্কে একটি প্রশ্ন এসেছিল কিন্তু উত্তর করা তো দূরের
কথা সেটা পড়েও দেখিনি!
তবে হুমায়ুন আহমেদের প্রতি যত ক্ষোভ, রাগ কিংবা ঘৃণা সব উঁবে গিয়ে তাঁর প্রতি আরও প্রচন্ড ভালোবাসা,
তাঁর লেখার প্রতি মগ্ন ভালোলাগা তৈরি হয় করোনাকালে। করোনার ভয়াবহতাকালীন সময়ে লকডাউনে যখন
গ্রামে আটকা পড়ি তখন কী করি, কী করি করতে করতে বন্ধুর পরামর্শে হুমায়ুন আহমেদের জ্যোছনা ও
জননীর গল্প মোবাইলে ডাউনলোড করে পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে তাঁর লেখায় এমনভাবে আটকে যাই যে তাঁর
হিমুসমগ্র, মিসির আলীসমগ্র, গল্প সমগ্র, ভৌতিক গল্প, ভ্রমনকাহীনি, সব উপন্যাসে আমার মোবাইলের
মেমোরি স্টোরেজ সম্মৃদ্ধ হতে থাকে। মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়, পানি পড়ে তাও
তাঁর লেখা পড়া থেকে বিমুখ করেনা। তাঁর নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, দেবী, মধ্যাহ্ন, দেয়াল, একজন
মায়াবতী, তন্দ্রাবিলাস উপন্যাস না পড়লে একজন পাঠক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একাঙ্গ অধরাই থেকে যেত।
দিন-রাত কিংবা সকাল-দুপুর-বিকাল নাই মোটকথা সময়ের হুঁশ হারিয়ে হুমায়ুনে মজে যাই। এখনো বিস্ময় বোধ
হয়, একজন মানুষ এতোকিছু এমন সুন্দর করে কীভাবে লিখলেন? আমার বিশ্বাস, হুমায়ুনে কোন ঐশ্বরিক
শক্তি ভর করেছিল।
এরপর শুরু হলো তাঁর নাটক দেখার পর্ব। আজও স্পষ্ট মনে আছে, এক বসাতেই তাঁর ৫৯ পর্বের ধারাবাহিক
নাটক এইসব দিনরাত্রি দেখা শেষ করেছিলাম। তাছাড়া তাঁর ধারাবাহিক বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নাই, নক্ষত্রের
রাত, আজ রবিবার কিংবা শুক্লপক্ষ ইত্যাদি নাটকের সাথে আর কীসের তুলনা হয়? তাঁর এক পর্বের
নাটকগুলোর মধ্যে জুতা বাবা, তারা তিনজন, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, প্রজেক্ট হিমালয়, বৃহন্নলা, ভুত বিলাস
কিংবা হিমু এখনো চোখের সামনে ভাসে! এখনো সময় পেলেই তাঁর নাটক দেখি। হয়তো দু’বার তিনবারও দেখি।
বাংলাদেশে তাঁর সমকক্ষ কোন নাটক নির্মাতা আজও জন্মগ্রহন করেনি। তিনি যে সকল কলা-কুশলী দিয়ে
নাটকে অভিনয় করিয়েছেন তাঁদের চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া ক্ষমতা ও প্রবনতা দেখলে মনে হয় এই সকল
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কেবল হুমায়ুন আহমেদের নাটকে অভিনয় করার জন্যই জন্ম হয়েছে। একজন
চ্যালেঞ্জার আবিষ্কার তাঁর জন্য কোন চ্যালেঞ্জই ছিল না। একথা বলতে দ্বিধা নাই, বাংলাদেশের সব নাটক
মিলে যতটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল কোথাও কেউ নাই নাটকটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ নির্মিত সিনেমাগুলি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর অনন্য বাস্তব ও
জীবন্ত দলীল। শ্যামল ছায়া(২০০৪) কিংবা আগুনের পরমশমনি(১৯৯৯) বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়েছে বলে বাঙালী
জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব হওয়া উচিত। তাঁর ‘যদি মন কাঁদে চলে এসো’-গানটি বোধহয় শ্রোতাদের মনে রোজ
দ্যোতনার সৃষ্টি করে। তাঁর সোনার কন্যা গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে সুর তোলে। তাঁর নির্মিত শ্রাবন
মেঘের দিন(২০০০), আমার আছে জল(২০০৮) এবং ঘেটুপুত্র কমলা(২০১২) কে তাঁর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে
বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য যে, ঘেটুপুত্র কমলাই এই মহান শিল্পীর নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র।
ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলায় হুমায়ুন আহমেদের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর বাদশাহ নামদার পড়লে মোঘল সম্রাট
হুমায়ুনের সাথে আমাদের হুমায়ুনের সরাসরি আলাপচারিতা হয়েছে বলেই বোধহয় । তিনি ইতিহাস সুনিপুন
ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলার একজন দক্ষ শব্দ শ্রমিক ছিলেন। তাঁর দেয়াল(২০১৩) উপন্যাস বাংলাদেশের
রাজনৈতিক বিবর্তনের চমকপ্রদ পান্ডুলিপি। হুমায়ুন আহমেদের মতো শক্তিশালী লেখক বাংলাদেশে দ্বিতীয়ীট
জন্মেছিল কিনা আমার জানা নাই। বাংলা ভাষায় বিশ্ব কবি ও জাতীয় কবির পর হুমায়ুনকে ততদিন স্মরণ করতে
হবে যতোদিন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে।
কাঠপেন্সিল, রংপেন্সিল ও লীলবতীর মৃত্যুর ছদ্মবরণে আত্মজীবনী লেখা আমাদের প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ
ওরফে বাচ্চু ২০১২ সালের আজকের(১৯ জুলাই) এই দিনে আমাদের ফাঁকি দিয়ে তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে চির
একাকীত্বের জীবনে চলে যান। কিন্তু হুমায়ুনরা পাঠকের হৃদয় থেকে কখনোই হারিয়ে যান না। সেখানে হুমায়ুন
আহমেদকে থাকতে হয়! আমাদের প্রয়োজনে হুমায়ুনকে আমাদের হৃদয়ে রাখতে হয়!
রাজু আহমেদ
Fb,com/rajucolumnist/