।
লেখক : রাজকুমার মাহাতো
।
পৃথিবী একটাই, তার ভাগ অনেকগুলো। এই যেমন ধরুন ভারত একটা দেশ, আবার আমেরিকা আরও একটা দেশ। এরকম অনেকগুলো দেশ আছে, আছে সেই দেশের শ্রেণীবিভাগ। আমেরিকা ধনী দেশ, ভারত গরীব দেশ আবার নেপাল নাকি একেবারেই গরীব দেশ।
তেমনি এই গরীব দেশ ভারতের ভিতরেও আবার প্রচুর শ্রেণীবিভাগ আছে। তার মধ্যে সবথেকে বড় শ্রেণীবিভাগ হল শহর আর গ্রাম। আবার সেই শহরের ভিতর আছে বড় লোকদের এলাকা, তথাকথিত ছোট লোকদের এলাকা। আর ব্যতিক্রম একটি এলাকা হল ‘দেহপাড়া’।
হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন ‘দেহপাড়া’ অথবা ‘বেশ্যাপাড়া’। সমাজের নিকৃষ্ট মানের উচ্চ প্রাণীরা থাকে সে পাড়ায়। যে পাড়ায় যেতে ভয় পায় ভদ্র সমাজের মানুষ, যেখানে পুরুষেরা মুখ লুকিয়ে যায়। দুঃখিত পৃথিবীর লোকেরা মুখ লুকিয়ে যায়। কারণ, সেই এলাকাকে তারা পৃথিবীর বাসযোগ্য অথবা সমতুল্য এলাকা বলে মনেই করে না।
বুঝতে একটু অসুবিধা হতেই পারে। সুবিধার জন্য বলে রাখি, দেহপাড়া বলতে এশিয়ার সবথেকে বড় যৌনপল্লীকে বুঝিয়েছি আমি। যেমন বইপাড়াতে বইয়ের কেনাবেচা হয়, ইলেকট্রনিক পাড়া ‘চাঁদনি চকে’ ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের কেনাবেচা হয়; তেমনি দেহপাড়াতে নারী দেহের কেনাবেচা হয়। রক্ত মাংসের নারী সেখানে কেবলই একটা পণ্য। যাকে পুরুষেরা কয়েক ঘণ্টার জন্য কেনে। প্রতি ঘণ্টায় হাত বদল হয় ওখানের নারীদের। নারী মানেই পণ্য বলেই ধরা হয় ওই এলাকায়।
সেখানকার নারীরাও নিজেদেরকে এখন পণ্য হিসেবেই গণ্য করে। কারণ, তাদের আর অন্য কোন পথ নেই। নিজেকে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গলিতে। যে পুরুষের পছন্দ যাকে, দরদাম করে দরজা হয় বন্ধ। শরীরী খেলা চালু হয়। শয়ে-শয়ে বন্ধ কুঠুরির মত ঘরগুলোতে তৃপ্তি মেটায় তথাকথিত সমাজের ভদ্র লোকেরা; আর তাদের সেই তৃপ্তি মেটাতে এখানকার নারীরা বেশ্যা রূপে পরিচিতি পায়।
সোনাগাছি উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি গুপ্ত নগরী। মহানগর কলকাতার পতিতা রূপ। ‘সোনাগাছি’-কে বলা হয় এশিয়ার সব থেকে বড় রেড এলার্ট এরিয়া। পৃথিবীর সব ধরনের মেয়ে পাওয়া যায় এখানে। কালো, ফর্সা, বেঁটে, লম্বা, চিনা, নেপালি, দেশি, বিদেশি সব ধরনের মেয়েই এখানকার পণ্য। দামের তফাৎ কেবল। ২০০ থেকে ১০০০০ টাকা দিয়ে বিক্রি হয় শরীর।
এখন আসা যাক এই সোনাগাছির আবিষ্কারের ইতিহাসে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এক ইংরেজ আবিষ্কার করেন শহর কলকাতা। তখন কলকাতা মানেই বাবুদের বাস। আর এই বাবুরা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করেছিলেন এই জায়গা। যার নাম তখন ছিল সোনাগাজি। হ্যাঁ তখন এই জায়গাটির নাম সোনাগাজিই ছিল। এই নামকরণ এর কারণে পরে আসছি। বাবুরা তাদের উপপত্নীদের এনে রাখত এখানে। তাদের জন্য বাবুরা তৈরি করেছিল বড় বেশ কয়েকটা কুঠি। যেগুলো এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই এলাকায়। তবে সেগুলি কুঠি থেকে রূপান্তরিত নাম নিয়ে বিল্ডিং এ পরিণত হয়েছে। যেই বিল্ডিং এর প্রতিটা ঘরে চলে শরীরী খেলা।
বহুকাল পূর্বে এই এলাকায় সানাউল্লাহ গাজি নামে এক সাধুবাবা থাকতেন। তার নাম অনুসারেই এই এলাকার নাম হয় ‘সোনাগাজি’। কথিত আছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের এলাকা ছিল এই সোনাগাজি। আর তার তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছিল এই এলাকা। তখনকার বিখ্যাত ‘বাবুরাজ’ এই যৌনপল্লীর আবিষ্কারে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিল। তারপর কালের বিবর্তনে ধীরে-ধীরে এই এলাকার নাম ‘সোনাগাজি’ থেকে ‘সোনাগাছি’ হয়।
কলকাতা শহর আবিষ্কারের পর ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর সৈন্য আসে কলকাতায়। তাদের বেশির ভাগটাই সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা যুবক। ১৭০০ – ১৮০০ শতক থেকে ইংরেজ যুবকরা দলে-দলে আসতে শুরু করে ভারতে। কলকাতা তখন তাদের মূল প্রবেশপথ। তখন সেই সব যুবকদের গরম রক্ত আর যৌনতার চাহিদা শহরের বিধবা মহিলাদের তুলে এই এলাকায় নিয়ে আসে। ধীরে-ধীরে বিধবা মহিলাদের সাথে কম বয়সী যুবতীদেরও বন্দী করা হয় এই এলাকায়। বাঘের মুখে তখন মানুষের রক্ত। বাবুদের সাথে-সাথে সেই গোরা মানুষদেরও প্রিয় জায়গা হয়ে ওঠে সোনাগাছি।
বাবুদের মনোরঞ্জনের কোন খামতি ছিলনা এই এলাকায়। তারা নিজেদের সমস্ত রকম সুবিধা ও গোপনীয়তা বজায় রাখতেন। সুযোগ সুবিধায় ভরিয়ে রাখতেন ওই সব মহিলাদের, যারা বাবুদের তথাকথিত উপপত্নী হয়ে থাকতেন। যাতে তারা পালিয়ে না যায়, তার জন্য পাহারাদার রাখতেন বাবুরা।
বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই এলাকায় বর্তমানে চোদ্দ হাজার যৌনকর্মী কাজ করেন। আর প্রতিবছর প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার নারীর হাত ফেরি হয় এই এলাকায়। তাদের কেউ বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে আসে, কেউ আবার স্বইচ্ছায় আসে এই এলাকায়। অল্প দিনে বেশি টাকা ইনকামের লোভ অনেক মহিলাকে টেনে আনে এই দেহপাড়ায়।
ভদ্র সমাজের কাছে সোনাগাছি একটি জঘন্য, নোংরা এলাকা হলেও আসলে এর মহত্ত্ব অনেক বড়। মা দুর্গা প্রতিবছর শরৎকালে আসেন বাপের বাড়ি। কুমারটুলিতে তখন মায়ের রূপ গড়ার প্রতিযোগিতা চলে, কার হাতের তৈরি মায়ের মূর্তি ঠিক কতটা সুন্দর! কিন্তু জানেন কি, এই বেশ্যা পল্লির মাটি ছাড়া মায়ের রূপ গড়া যায় না। হ্যাঁ, ওই নিষিদ্ধ পল্লির মাটি ছাড়া মা দুর্গা অসম্পূর্ণ, মায়ের রূপ অসম্পূর্ণ। কারণ, সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ-লক্ষ মানুষ এই জায়গায় আসে নিজের কামনা নিয়ে আর তার যতটুকু পুণ্য থাকে, সেটি শুষে নেয় এখানকার মাটি। তাই ‘সোনাগাছি’-র মত অথবা নিষিদ্ধ পল্লির মত পবিত্র মাটি ছাড়া মায়ের রূপ হয়নি আর হয় না।
সবশেষে বলা যায়, এই এলাকা আছে বলেই হয়ত আজ আমাদের মেয়ে বোনেরা কিছুটা হলেও সুরক্ষিত। কারণ, পুরুষের কামনা তাকে সব ভুলিয়ে দেয়। শরীর পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে তখন তারা। আর এখানের এই ‘নিষিদ্ধ ‘ মহিলারাই তাদেরকে ধরে রাখে। তা না হলে ভারতে তথা মহানগরে ধর্ষণের সংখ্যাটা বোধহয় আরও বেড়ে যেত।
( সমাপ্ত )