দেহব্যাবসায়ীদের কি ‘যৌনকর্মী’ বলা যায় ? দেহোপজীবিনীরা কি শ্রমিক ? কী বলছেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ? –- “চরম দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে সমস্ত মেয়েগুলোকে ধরে এনে দেহব্যাবসা করানো হচ্ছে, তাঁদের পুনর্বাসনের না করে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আরও জাঁকিয়ে ব্যাবসা করার দাবি জানানো হচ্ছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে ? যৌনকর্মীরা চাইছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, ভাবা যায় ! আরে বাবা, ব্যাবসা হল সাধারণত দু-রকম । এক, সুস্থ ও আইনি ব্যবসা । দুই, অসুস্থ ও বে-আইনি ব্যাবসা। এখন যে ব্যাবসাটা আপাদমস্তক অসুস্থ ও বে-আইনি, তার আবার ট্রেড ইউনিয়ন কীসের, আমার মাথায় তো কিস্যু ঢুকছে না। আর এই দাবির পিছনে যুক্তিটা কি, না আইনের অধিকার পেলে যৌনকর্মীদের ব্যাবসা করতে আরও সুবিধে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ব্যাবসা চালাতে আজও কি আইন তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে ? দেয়নি। সুতরাং যে পেশা বা ব্যাবসার কোনো আইনি ভিত্তিই নেই, সে ব্যাবসার আবার পরবর্তী সুযোগসুবিধা নিয়ে ভেবে কী লাভ ? আজ যৌনকর্মীরা তাদের শ্রমিক বলে দাবি করছে। তাঁদের গতর খাটানোর সঙ্গে শ্রমিকের গতর খাটানোর তুলনা করছে।খুব নিষ্ঠুর অর্থে তাঁদের এবং শ্রমিকের গতর খাটানোর এই তুলনাটা মেনে নিলেও, জানতে ইচ্ছে করে একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের যে দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা রয়েছে ! নিশ্চয় নয়। যদিও তাঁদের বক্তব্য, যৌনকর্মী না-থাকলে আজ ঘরে ঘরে এই দেহব্যাবসা হত, যে ব্যাবসা বন্ধ করেই নাকি সোনাগাছি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের মতো যৌনপল্লির প্রয়োজন। এটা একেবারেই অযৌক্তিক কথা।যেমন অযৌক্তিক তাদের এই দাবি। আরে বাবা, আইনের স্বীকৃতি পেলেই কি মানুষের মানসিকতা, সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ পালটে যাবে ? এটা কখনো হয় নাকি ? শের শাহের আমলেও তো নিয়ম ছিল চুরি করলে হাত কাটা যাবে, তা বলে কি চুরি থেমে থেকেছে ? সুতরাং আইনি স্বীকৃতি পেলেই যৌনকর্মীরা শ্রমিকের স্বীকৃতি পেয়ে যাবে, সমাজের স্বীকৃতি পেয়ে যাবে, এমন চিন্তাভাবনার কোনো কারণ নেই”।(টপ কোয়ার্ক. ডিসেম্বর ২০০৪, ৭০ পৃষ্ঠা)
অশোকবাবুকে অনেকে রক্ষণশীল বলতেই পারেন। তাঁর সঙ্গে কেউ একমত হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। তবে আমি বলি কী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ নামবে, এটিকেও সেভাবেই দেখা দরকার। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার তৎকালীন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯টি বেশ্যাঘর আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করছিলেন মোট ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। অর্থাৎ গৃহপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও বেশি। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেভার-টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন নির্ধারণ করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪২৭১ জনে। ১৯২১ এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে উল্লিখিত সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে পুলিশের হিসেবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের পরে অনেক দিন বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। বিশ্বায়নের থাবায় দিকে দিকে দারিদ্র্য আরো বেড়েছে, বেড়েছে পাচার, বেড়েছে উন্মত্ততা। ফলে বর্তমানে কলকাতা শহরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে বৈ তো নয়। দেবাশিস বসুর দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের মহামারীতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায় তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করে গৃহও ধরা হয়, তাহলে মোট গৃহ দাঁড়ায় ৩৮০০টি, এবং গৃহপ্রতি ৩ জন করে ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ ধরা হয় তবে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০ জনে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসেবটা ঠিক এরকমই। তাদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে বেশ্যাপাড়ানির্ভর ১২,০০০ জন এবং ফ্লটিং ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই অঙ্কে আবাসিক হোটেল এবং ফ্লাটবাড়িভিত্তিক যৌনকর্মীদের চিত্রটি নেই। এই ভাগে আরো ২০,০০০ জন থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,০০০ জনে। আমরা অন্য দেশের একটি শহরের হিসেবটি এত নিখুঁতভাবে দেখতে চেষ্টা করছি এ কারণে যে এখানকার যৌনকর্মীদের একটি বড়ো অংশই বাংলাদেশের নারী ও শিশু। রয়টারের একটি সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩০ হাজার মেয়েশিশু আছে কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে এবং ১০ হাজার আছে মুম্বাই এবং গোয়ার পতিতালয়ে। এসব নারী ও মেয়েশিশুর সবাই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছেন। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২০০,০০০ নারী পাচার হয়েছেন। এছাড়া এসময়ে মোট ৬০০০ মেয়েশিশু পাচার বা অপহৃত হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে। ইন্টার প্রেস সার্ভিস (৮ এপ্রিল ১৯৯৮) সূত্রে জানা যায়, পাচারকৃত এই দু-লক্ষ নারীর সবাই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একটি বিদেশী সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কিত কান্ট্রি নেরেটিভ পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে যেসব নারী গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করবার জন্য কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে যান, প্রায়শ তাঁদেরও অনিচ্ছাকৃত যৌনদাসত্বকে মেনে নিতে হয়। ওই পেপারের মতে, বার্মিজ মেয়েদের পাচারের রুট হিসেবেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে।বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছে দুর্জয় মহিলা সমন্বয় কমিটি।
যৌনকর্মীদের জাতীয় আন্দোলন : দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকার যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার) , সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এইডস মোকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র) এবং উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)।
ভারতে যৌনপেশা সম্পর্কীত এখন যে আইন চালু আছে (ইম্মরাল ট্র্যাফিক প্রিভেন্শন অ্যাক্ট, ১৯৫৬), তার সংশোধনের জন্য ভারত সরকার সম্প্রতি যে প্রস্তাবের খসরা তৈরি করেছে, তার প্রতিবাদের দুর্বার এবং উপরোক্ত সংস্থার প্রায় ৪০০০ যৌনকর্মী প্রতিনিধি দিল্লিতে গত ৩ থেকে ৮ মার্চ সমবেত হন এবং সভা-সমিতি, র্যালি , পথনাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেন। সবচেয়ে বেশি আপত্তি হল এই সংশোধনী প্রস্তাবের একটি ধারা সম্বন্ধে যাতে যৌনকর্মীর খরিদ্দারদের আইনত অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেওয়া হবে। ৮ মার্চ তাঁরা একটি শোভাযাত্রা করে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। সেটাতে তাঁরা এই সংশোধনী প্রস্তাবটি বিলোপ করা ও পিটা আইনের কিছু ধারার সংশোধন করার জন্য আবেদন করেন। ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবি করা এবং ইতিমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করতে পেরেছেন। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মতো এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিলেন না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসেবে গণ্য হবে।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি : এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্যে সোনাগাছির পিয়ার এডুকেটররা, প্রকল্পের ডাক্তার, সমাজসেবিকা ইত্যাদির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন যে, ওখানকার যৌনকর্মীদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে এবং তাঁদের খরিদ্দারদের কাছে দলবদ্ধভাবে কন্ডোম ব্যবহারের দাবি করতে হবে। পিয়ার এডুকেটরদের উদ্যোগে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি নামে যৌনকর্মীদের একটি সংস্থা তৈরি হল। এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হল যে, যৌনকর্মকে একটি ন্যায্য পেশার স্বীকৃতির দাবি করা, সাধারণ নাগরিকদের যেসব ন্যুনতম অধিকার আছে যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকে সেসব অধিকার দাবি করা এবং এইসব অধিকার আদায় করার জন্য সঙঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যাওয়া। প্রথম লড়াই শুরু হল খরিদ্দারদের সঙ্গে যাতে তাঁরা যৌন সংসর্গে কন্ডোম ব্যবহার করেন। খরিদ্দাররা যখন দেখলেন যে কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক বলে কোনও যৌনকর্মীর কাছে প্রত্যাখ্যত হলে আশেপাশের সব যৌনকর্মীর কাছ থেকেই তিনি একই কারণে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন — বেশি টাকা দিতে চাইলেও, তখন তাঁরা কন্ডোম ব্যবহার করতে রাজি হতে থাকলেন। এর ফলে সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার বেশ দ্রুত হারে বাড়তে থাকল এবং তাঁদের যৌনরোগের সংক্রমণ কমতে থাকল। এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যাও ভারতের অন্যান্য জায়গার যৌনকর্মীদের মধ্যে যতটা বাড়তে থাকল, সোনাগাছিতে ততটা বাড়ল না। ২০০৬ সালে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের অনুপাত শতকরা ৬-এর মত, কিন্তু মুম্বাইয়ের কামাতিপুর এলাকায় শতকরা ৫০-এর বেশি এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক জায়গায় শতকরা ৩০-এর বেশি। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের অনুপাত অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ হল তাঁদের খদ্দেরদের কন্ডোম ব্যবহার করতে রাজি বা বাধ্য করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে বলে। দুর্বারের নানাবিধ কার্যক্রম মাধ্যমে তাঁরা জীবনের অন্যান্য আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়েছেন। এর একটা প্রধান উদাহরণ হল উষা কো-অপারেটিভ নামে নিজেদের একটি সমবায় সংস্থার সৃষ্টি করে স্থানীয় সুদখোর কুসিদজীবীদের শোষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া। যৌনকর্মীদের অনেকেই দৈনিক রোজগার থেকে কিছু টাকা এই সংস্থায় জমা রাখেন এবং অসুখ-বিসুখ বা অন্য কারণে বাড়তি টাকার দরকার হলে এই সংস্থা থেকে অল্প সুদে টাকা ধার করতে পারেন। উষা কো-অপরেটিভের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০০ এবং সারা বছরে এর মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
যৌনকর্মীদের এবং যৌনপেশাকে নির্মূল করা-না-করার প্রশ্নে, পুনর্বাসন প্রশ্নে, নৈতিকতা প্রশ্নে, ধর্মীয় প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে নানারকম তর্ক-বিতর্ক আমরা শুনে থাকি। অর্থশাস্ত্র মতে, বাজারে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে সে পণ্যের উৎপাদন রহিত করা যায় না। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে তার উৎপাদন চলতেই থাকে। যৌনপণ্যের বাজারচাহিদা কমানো না-গেলে চিহ্নিত “রেড লাইট এরিয়া”-গুলিকে তছনছ করে দিলেও অন্য কোনো ছদ্ম-আবরণে এ ব্যাবসা চলতেই থাকবে। তাতে মাত্র একদল যাবে, একদল আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
কিন্তু লক্ষণীয় যে বেশ্যাবৃত্তি টিকিয়ে রাখার পক্ষে দেওয়া সর্বকালের সকল মতই হল পুরুষদের। কারণ এ প্রথার ভোক্তা পুরুষরাই। প্রত্যক্ষভাবে নারীনেত্রীদের বেশ্যাবৃত্তির পক্ষে সাধারণত মত দিতে দেখা যায় না। নারীরা এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত — এক ভাগের নেত্রীরা বেশ্যাবৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে যৌন-নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসাবে দেখেন। তাঁরাই চান এ ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হোক। এ সকল নারীনেত্রীদের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে সুইডেনে একটি আইনও তৈরি হয়ে গেল। সেখানে বলা হল — যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা ক্রয় অবশ্যই অপরাধ। এই আইন যৌনসেবা ক্রয়ে ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে । আর ক্রেতা যখন থাকবে না তখন এটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। অন্য পক্ষের নারীগণ মনে করেন — পতিতাদের অধিকার, নিজস্ব ইচ্ছা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে দেখেন। তাঁরা পতিতাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যথার্থে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করে পতিতালয় উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন এবং এই পেশাকে কর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বলেন। দেহব্যবসায়ে নিয়োজিতদের পতিতা, বেশ্যা, গণিকা, খারাপ মেয়েছেলে ইত্যাদি না-বলে যৌনকর্মী এবং তাদের কর্মকে যৌনকর্ম বলার পক্ষে পৃথিবীব্যাপী তাদের আন্দোলনও জারি করা আছে।এরা জার্মানিতে আইন সংস্কারের জন্য চেষ্টা করার ফলে গত ২০০২ সালে সে দেশে যৌনকর্ম একটি নিয়মিত পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ওই আইনে যৌনকর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত করেছে। সারা পৃথিবীতেই এই দাবিতে আন্দোলন সচল আছে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘও এরকম দাবিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছেন।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে স্বেছায় যুক্ত হয়েছেন বা পাকেচক্রে শরীরের ব্যাবসায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন বা কিনছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পৌর-কর্তৃপক্ষ ১৯৯২ সালে শহরের যৌন-বিনোদন কেন্দ্রগুলি ভেঙে দেওয়ার পর সেখানকার যৌনকর্মীরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে ওদেশে বিভিন্ন ধরনের যৌনরোগ ও এইচআইভির সংক্রমণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
সত্যিকারেই বেশ্যাবৃত্তি নিশ্চয় সমাজ থেকে নির্মূল করা যাবে না। কেন-না সমলিঙ্গ কিংবা ভিন্ন লিঙ্গের সঙ্গে সহবাস করে বহু প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছায় প্রচুর অর্থ ও সম্পদ অর্জন করে থাকে। এ ধরনের নারী-পুরুষের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে নেহাত কম নেই। আসলে প্রতিটি নারীপুরুষনির্বিশেষে মানুষের ভিতর বহুগামিতা কমবেশি থাকে। নানা সামাজিক অবস্থানের কারণে কারোর এই জীবনযাপন প্রকটিত হয়, কারোর-বা প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। আমার মনে করি না যেসব প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী একাধিক নরনারীর যৌনমিলন করে রোজগার করে তারা নিষিদ্ধ হোক। তা কোনোদিনই সম্ভব নয়। কঠোর আইন করেও সম্ভব নয়। কিন্তু যেসব মেয়েরা নানা ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে বেশ্যাপল্লির অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।কীভাবে ? প্রথমত, দেশের সমস্ত অনিচ্ছাকৃত প্রতিটি বেশ্যাদের বেশ্যাপল্লি থেকে বাইরে বের করে এনে বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত করে পুনর্বাসন দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রস কোয়ার্টারের বা বেশ্যাবাড়ির বাড়িওয়ালিদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করতে হবে এবং পাড়াগুলি বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।তৃতীয়ত, মেয়ে-পাচারকারীদের সনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। চতুর্থত, ভবিষ্যতে যদি কেউ কোনো মেয়েকে প্ররোচনা দিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করলে লাইফার অথবা মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তির বিধান রাখবে হবে।বেশ্যামুক্ত একটা দেশ হয়তো উপহার দেওয়া যাবে না, কিন্ত যৌন-ক্রীতদাস নির্মূল সম্ভব।পেশা নির্বাচনের অধিকার সকলকেই রাষ্ট্র দিয়েছে।জবরদস্তি কোনো পেশায় কারোকে ঠেলা দেওয়া মানে মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন।যেসব মেয়েদের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয় কেউ, তখন সেই সংশ্লিষ্ট মেয়েটির মৃত্যুরই সামিল হয়।
যাঁরা বেশ্যাদের নিয়ে বেশ্যাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই চাইছেন বেশ্যিবৃত্তিকে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করতে। সামনে ফেস্টুন টাঙিয়ে যৌনকর্মীর অশ্রুপাত করছেন, পিছনে পিছনে এই বৃত্তিকে পাকাপোক্ত করে তোলার বন্দোবস্ত করে যাচ্ছে। এনজিও চালানোর নামে বিদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার আসছে, আর হরির লুটের বাতাসা হচ্ছে।পতিতাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তিকে রোধ করতে হলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আসলে বেশ্যারা মানুষ। আর মানুষ বলেই তাঁরা তাঁদের মেয়েদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। মানুষ বলেই আশা আছে তাঁরা ‘যৌনকর্মী’ সংগঠনের নেতা-উপদেষ্টাদের ভেন্ট্রিলোকুইজমের পুতুল হয়ে অনন্তকাল থাকবে না। সেদিন এই মেয়েদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে থাকা পুলিশ-মস্তান-বাড়িওয়ালিদের মতোই এইসব ‘যৌনকর্মী’ সংগঠনের নেতৃত্বকে তাঁরা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলবে।সামাজিকভাবে সকলে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আশা করা যায় বেশ্যাবৃত্তি বা বেশ্যালয়কে সমাজ থেকে ধ্বংস করা যাবে। লাস ভেগাস, ম্যাকাউয়ের বিখ্যাত বেশ্যালয়গুলি অতীত হয়ে যাক বললেই কী অতীত হয়ে যাবে ? স্বপ্ন দেখার অধিকার থাকলেও, আশা করার মতো এমন কোনো উপাদানই আমি দেখতে পাচ্ছি না।
http://blogger-anirban.blogspot.com/