বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পার না হতেই অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রাখা ছাত্রদের সাথে নির্বাচনসহ কয়েকটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ সময়ের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সাথে দূরত্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে থাকা তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নির্বাচন ও নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকার নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু নির্বাচন বিষয়ক ইস্যুই নয়, বরং রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া ও ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগকে যেভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে বিএনপি তা উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট ও দূরত্বের মাত্রা বাড়িয়েছে। দুটো উদ্যোগই আন্দোলনকারী ছাত্রদের দিক থেকে এসেছিলো। এখন আবার নতুন করে ছাত্রদের দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর আগে জুলাই-অগাস্টের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন “বিএনপি কেন যেন মনে করে সরকারটা হয়েছে কেবল একটা নির্বাচন দেয়ার জন্য। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা সরকার আছে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য, যে সময়ে তারা বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন করবে”।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন ‘বিএনপি কিছু অপ্রয়োজনীয় দূরত্ব সরকার বা ছাত্রদের সাথে তৈরি করেছে’। তবে এটার প্রয়োজন ছিলো না বলেই তিনি মনে করেন। যদিও মির্জা ফখরুল বলছেন যে শুরু থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক ছিলো এখনো তেমনটিই আছে।
তবে মির্জা ফখরুল বিভিন্ন বিষয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে নাহিদ ইসলাম ছাড়াও পাল্টা মন্তব্য করেছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। আবার বিএনপির দিক থেকে মির্জা ফখরুলের মন্তব্যকে সমর্থন করে কথা বলেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাস ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভিও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে মতপার্থক্যের শুরু হয়েছিলো বিএনপি ও সরকারের মধ্যে, সেটিই আরও প্রকট হয়েছে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন ও জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে এসে।
তার মতে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এটি পরিষ্কার যে, তারা মনে করছেন বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া বা বিলম্ব করানোর একটা চেষ্টা সরকারের ঘনিষ্ঠ কোন কোন মহল করছে বলে তারা মনে করেন। এ কারণেই উভয় পক্ষের মধ্যে এখন মতপার্থক্য ক্রমাগত বাড়ছে বলে তার ধারণা।
আরেকজন বিশ্লেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে পরস্পরের ওপর যে আস্থার সংকট সেটাই উভয়পক্ষের মধ্যে দূরত্বের মূল ভিত্তি।
আমার মনে হয় ছাত্ররা কতদূর যেতে চায় সেটা নিয়ে বিএনপিতে উদ্বেগ আছে, আবার ছাত্রদের মধ্যে উদ্বেগ আছে যে বিএনপি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসলেও এখনকার সংস্কার কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে কি না, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
নির্বাচনের সময়, রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন ও জুলাই ঘোষণাপত্র : গত বছরের আটই আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিএনপি দ্রুততম সময়ের নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ দাবি করে আসছিলো। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দুটি ভাষণে তা না থাকায় আক্ষেপও প্রকাশ করেছিলো দলটি।
পরে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে উল্লেখ করলেও তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি বিএনপি। বরং জামায়াতসহ কিছু দল ও সংগঠন নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব দিলে তাতের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপি এবং এই ইস্যুতেই জামায়াতের সাথে দৃশ্যমান বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে দলটি।
আবার অন্যদিকে গত অক্টোবরে দৈনিক মানবজমিনে র প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন যে রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোন দালিলিক প্রমাণ তার হাতে নেই।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক কমিটি রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনে তীব্র চাপ সৃষ্টি করলেও ‘সাংবিধানিক সংকট’ হবে উল্লেখ করে বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে আর পরিবর্তন করা যায়নি।
ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলছেন, আমরা পছন্দের কাউকে রাষ্ট্রপতি করতে চাইনি। আমরা চেয়েছি এই রাষ্ট্রপতি সরে যাক। আমরা বলেছিলাম প্রয়োজনে সবাই মিলে একজনকে ঠিক করি। আমরা তো পছন্দের কাউকে রাষ্ট্রপতি করতে চাইনি।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আপত্তির কারণ খুব সঙ্গত কারণ। আমরা তো একটা সংবিধানের অধীনে আছি। রাষ্ট্রের যে সংবিধান, সেই সংবিধানের অধীনে আমরা আছি। এই সরকারও শপথ নিয়েছে সেই সংবিধানের অধীনে। সেখানে রাষ্ট্রপতিকে যে অপসারণ করবে, সেটা কে করবে? এটা এক।
দুই নম্বর হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি আনবেন কাকে? তিন নম্বর হচ্ছে, এটার লেজিটেমেসি কার হাতে থাকবে? পার্লামেন্ট নাই। সুতরাং ওই প্রশ্নটাকে আমরা মনে করি যে, অবাস্তব প্রশ্ন।
অন্যদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলছেন ছাত্ররাই একাই তো এটা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু সেখানে বিএনপি বাধা হয়ে দাঁড়ালো। বিএনপি মহাসচিব হন্তদন্ত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে গেলেন, বললেন এভাবে ছাত্ররা করলে অনৈক্য তৈরি হবে।
তবে এ বিষয়ে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন ‘এটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয়নি আগে, আমরা জানিও না এটা। আর (অভ্যুত্থানের) পাঁচ মাস পরে এই ডিক্লারেশনের কোনো যুক্তি আছে কি না?’
এছাড়াও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও বিএনপির সাথে ছাত্রদের মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেছেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে রাজনীতি করে, তাদেরকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটাতে আমরা কখনোই একমত হইনি। এটা আমরা বলেছি যে, জনগণ ডিসাইড করবে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে-কি হবে না।
নাহিদ ইসলাম বলছেন, এ বিষয়ে সবার অবস্থান আরও পরিষ্কার করা দরকার। নিরপেক্ষ সরকারের নামে আওয়ামী লীগকে আশ্রয় দেয়ার ষড়যন্ত্র হলে মানবো না। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করানোর দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। আশা করি কেউ এ ষড়যন্ত্রে পা দিবে না।
ওদিকে বিএনপি মহাসচিব যে বলেছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে এসে সেটা করা উচিত,তার জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেছেন সরকারে থেকে কেউ নির্বাচনে অংশ নিবে না।
উপদেষ্টা নাহিদ অভিযোগ করেছেন, উদ্দেশ্য করে না বলেও বিএনপির কথার টোন আওয়ামী লীগের সাথে মিলে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
জনআকাঙ্খা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে দূরত্ব আরও বাড়বে : রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে বিএনপির শক্ত অবস্থান নেয়াটাই আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাথে তাদের মতপার্থক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলো।
তাদের মতে, এছাড়া সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কার কথা বলে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে এবং প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন তুলে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধে বিএনপির শক্ত অবস্থান ছিলো আন্দোলনকারী ছাত্রদের অবস্থানের বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা। এছাড়া বিএনপি মাঝে মধ্যেই মাইনাস টু ফর্মুলার কথাও তুলে ধরছে। এসব ইস্যুতে শুধু সরকার বা আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাথে নয় বরং জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথেও বিএনপির ঠাণ্ডা লড়াই স্পষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসতে পারবে কি না তা জনগণের ওপর যেভাবে বিএনপি ছেড়ে দিতে চাইছে সেটি আন্দোলনকারী ছাত্ররা মেনে নিতে পারছে না, যা তাদের মধ্যকার বিরোধকে আরও চাঙ্গা করে তুলতে পারে।
প্রসঙ্গত, শনিবার চাঁদপুরে ছাত্র জনতার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন ‘আওয়ামী লীগকে কোনভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলছেন, জনআকাঙ্খা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, সমাধান হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেটি কখন করা উচিত সে বিষয়ে ঐকমত্য হবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যতদিন যাবে তত অনিশ্চয়তা বাড়বে। তাদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়বে। পাশাপাশি জনমনে আশঙ্কা ও অস্থিরতা বাড়বে কারণ অনেকেই এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে।