বিসিএসের ভবিষ্যৎ: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের স্থানান্তর প্রশ্নে ভাবনা

 

তারুণ্যের কাছে বিসিএস স্বপ্নের বিকল্প। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস সম্মিলিতভাবে
নিজেই সুন্দর। আলাদা করে কোন ক্যাডার বিশেষের নামে বিসিএসকে সাজসজ্জা
করতে হয় না। সামাজিক সম্মান, আর্থিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় খেদমতে
বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারদের এক নম্বরের পছন্দ বিসিএস। চাকুরির বাজারে
বিসিএসের শীর্ষে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবছর ধারাবাহিক সার্কুলার, উল্লেখযোগ্য
সংখ্যক শূন্যপদে ক্যাডারে চাকুরি এবং প্রায় শতভাগ স্বচ্ছ নিয়োগ- এগুলো মূল
ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ২৬ টি ক্যাডারের সমন্বয়ে বাংলাদেশ
সিভিল সার্ভিস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিগত সরকারের পতনের পরে
গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানামুখী সংস্কারের নিমিত্তে কমিশন গঠন করেছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তন্মধ্যে অন্যতম। কোন সরকার ভালোভাবে চলবে
নাকি স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে, জনগণ সেবা পাবে নাকি ভোগান্তিতে ডুববে- তা
যাদের কর্মকান্ডে নির্ধারিত হয় তা মূলত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগকৃত
কর্মচারীদের আচরণেই প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সবাই যেহেতু
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সেহেতু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অত্যন্ত
জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক্ষেত্রে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে গণমানুষের
প্রত্যাশা পূরণ করেছে।

তবে অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কমিশনটির প্রায় সকল সদস্য নির্দিষ্ট
পরিমন্ডলের জনবল দিয়ে গঠিত হয়েছে। এখানে সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য সকল
ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেটা বিবেচ্য-বিতর্কেও ছিল
না। কেননা সৎ ও নিরপেক্ষ মানুষ যেখান থেকে কো-অপ করা হোক, তাদের
দ্বারা সামগ্রিক উন্নতি হবে- সেটাই আকাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার
কমিশন যতগুলো সুপারিশ জমা দিয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে
ক্যাডারবহির্ভূত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। অবশ্য সুপারিশই শেষ কথা

নয়। অন্তবর্তীকালীন সরকার নিশ্চয়ই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এর যৌক্তিকতা-
অযৌক্তিকতা অনুসন্ধান করবে। এবার একটু দেখা দরকার বিসিএস এতো
আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার হেতু কী? সুযোগ-সুবিধা, অর্থ-স্বাধীনতায় বাংলাদেশে
বেশি বেতনের অনেকগুলো সেক্টর থাকার পরেও তরুণদের এক নম্বর পছন্দে
কেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস? প্রায় প্রতিবছর সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য
বাংলাদেশ কর্ম কমিশন কর্তৃক যে বিজ্ঞাপন প্রকাশিক হয় তাতে বিভিন্ন ক্যাডারে
নিয়োগের জন্য শূন্যপদ থাকে দুই হাজারের আশেপাশে। এছাড়াও প্রথম ও দ্বিতীয়
শ্রেণীতে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নন-ক্যাডার সুপারিশ করা হয়।

প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ভাইভায় অবর্তীর্ণ হয় এবং
চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয় তাদের প্রায় সবাইকে যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সেক্টর-
দপ্তরের জন্য সুপারিশ করা হয়। বিগত কয়েকটি বিসিএসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক
নন-ক্যাডার সুপারিশ বিসিএসের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। বেকারদের কাছে
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন বাড়িয়েছে অনেকগুণ। কর্ম কমিশন থেকে ফি বছর
যে বিজ্ঞাপন ঘোষিত হয় তাতে বিসিএস প্রশাসনে ২০০-৩০০টি শূন্যপদ,
পুলিশের জন্য ১০০ এর আশেপাশে শূন্যপদ থাকে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে
বিভিন্ন সাবজেক্টে ৮০০-৯০০টি শূন্যপদ এবং স্বাস্থ্য কাডারের ৫৫০-৬৫০টি
শূন্যপদ থাকে। মোটকথা, যেকোনো বিসিএসের শূন্যপদের সার্কুলারে গড়ে মোট
পদের দুই তৃতীয়াংশ পদ বিসিএস শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের থাকে। মেধা,
যোগ্যতা ও ভাগ্যের হেরফেরে এখানে সম্মানজনক একটি চাকুরি পাওয়া যায়-
বিসিএসের মূল্যবান হওয়ার এটাই অন্যতম কারণ।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিসিএস থেকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকে বাদ
দিলে অন্য ২৪টি ক্যাডার মিলিয়ে ক্যাডারের শূন্যপদ থাকবে ৫০০-৬০০টি।
তাতে বিসিএস নিয়ে বেকার তরুণ এমনকি পাবলিকের মধ্যে যে উৎসুকভাবে
অপেক্ষা, শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে স্বপ্ন তাতে ভাটি

আসবে- যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে বিসিএস থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
প্রশাসন ক্যাডারের সাথে বাকি ২৫টি ক্যাডারের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই দীর্ঘদিনের।
ক্যাডারসমূহের মধ্যে আন্তঃবৈষম্য দূরীকরণের দাবি ও আন্দোলন ধারাবাহিকতায়
চলছে। ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে আবার কারো কারো নিজেদেরকে আশরাফ ভাবা
এবং কাউকে আতরাফ করে রাখা- দূরত্ব বাড়িয়েছে ঢের। জনপ্রশাসন সংস্কার
কমিশনের সুপারিশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারবহির্ভূত করার মনোভাব এই
সম্পর্কের কফিনে সর্বশেষ পেরেক ঠুকেছে। সংস্কারের নামে এক্ষেত্রে নতুন বৈষম্য
সৃষ্টির যে পাঁয়তারা হচ্ছে তা থেকে নিবৃত্ত হওয়া দরকার। সরকার নিশ্চয়ই
মাঠের বাস্তবতা এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য কাডারের মনোভাব বুঝবে এবং তা আমলে
নেবে। কারো স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন
সরকার নেবে না- এমন আশা পোষণ করি।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য জনবল অন্যকোন কমিশনের অধীনে নিয়োগ দেওয়া হবে
এবং প্রয়োজনে তাদেরকে বেশি বেতন দেয়া হোক- এমনটাই জনপ্রশাসন সংস্কার
কমিশনের সুপারিশের ভাষ্য। অতীতে বিসিএসে অন্তর্ভুক্ত ছিল অথচ এখন
আলাদাভাবে নিয়োগ পরীক্ষা হয়- জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। বিচারবিভাগ স্বাধীন
হওয়ার পরে বিচারকদের আলাদা নিয়োগ পদ্ধতি চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা
দিয়েছিল। সেই নীতি যদি অনুসরণ করা হয় তবে বিসিএস থেকে বিসিএস
প্রশাসন ক্যাডারকে আলাদা করে তাদেরকে নতুন বিধিমালায় নিয়োগ প্রদান করা
যেতে পারে। সেটা যৌক্তিকও।

বিসিএস প্রশাসনের সাথে অন্যান্য কাডারদেরকে সংযুক্ত রাখাও যৌক্তিক নয়।
কারণ অন্যান্য ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তারাও বিসিএস প্রশাসনের জুনিয়র
কর্মকর্তাদের অধীনে চলে আসে কিংবা আসতে বাধ্য করা হয়। উপজেলায়
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অধীনে মৎস, কৃষি কিংবা অন্যান্য ক্যাডারের
সিনিয়র কর্মকর্তারা কর্মরত আছেন। এটা তাদের জন্য মানসিক অস্বস্তিকর

ব্যাপার। অসম্মানের পথে গ্লানি তো বহন করেই। কাজেই এই বৈষম্য দূরীকরণের
জন্য বিসিএস প্রশাসনের জন্য আলাদা কোন কমিশন করে তাদেরকে নিয়োগ
দিলে সেবার বিষয়টি মসৃণ ও যৌক্তিক হয়। বিজেএস পরীক্ষার মত বিকল্প
কোন বিসিএস!

বিসিএস প্রশাসন বনাম অন্যান্য ক্যাডার- কাল্পনিক দেয়ালে সৃষ্ট বিভাজন
দীর্ঘদিনের। পুলিশ ক্যাডার মোটামুটি বাফার বা নিরপেক্ষ জোনে ছিল কিন্তু
জেলা প্রশাসকদের কাছে এসপিদের এসিয়ার যাবে কিংবা সকল মামলা বিষয়ে
জেলা প্রশাসনকে পুলিশদের অবহিত করতে হবে- এমন গুঞ্জন যখন ওঠে তখন
দু'য়ের মধ্যে দূরত্ব ও রেশারেশি সৃষ্টি হয়। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগকৃত
পুলিশদের দলীয় পদ-পরিচয় খোঁজা নিয়ে যে উত্তাপ তা প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রায়
শিথিল। অথচ বিগত নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলীয় মনোভাবাপন্ন প্রশাসনের
দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি ছিল। বৈষম্যহীন সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য যার
যার মন্ত্রণালয় তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। কৃষির উন্নয়নের জন্য একজন কৃষি
বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এভাবে মৎস, বন, রাস্তা-
সেতু, শিক্ষা-স্বাস্থ্য- যার মন্ত্রণালয় তার হওয়া উচিত। উচিতেরও অধিক
যৌক্তিক। একজন আমলা ভালো শিক্ষক হতে পারলেও ভালো ডাক্তার-
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ নাই!

শিক্ষা নিয়ে যত বিতর্ক, কারিকুলাম-সিলেবাসকে যতবার অপারেশনের টেবিলে
নেওয়া- সেটা কোনভাবেই লাগতো না যদি এদেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদগণ
শিক্ষাক্রম নির্ধারণের দায়িত্বে থাকতো। স্বাস্থ্যসেবার যত অধঃপতন তা স্বাস্থ্যের
ওপর অ-স্বাস্থ্যকর খোঁচাখুঁচিতে হয়েছে। শিক্ষক-ডাক্তারগণ কেবল টাকার জন্য
কিংবা টাকার লোভে চাকুরি তথা সেবা প্রদান করেন না। নয়তো অনেক
ডাক্তারকেই বিসিএস দিয়ে নির্ধারিত বেতনে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালের গিঞ্জি
পরিবেশে চিকিৎসা দিতে হয় না। চেম্বার দিয়ে সকাল বিকাল কোন

ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসলে রোগীর অভাব থাকে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
ক্যাডারকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বাইরে নেওয়ার অপচেষ্টা করে যাতে
নতুন সমস্যা উসকে দেওয়া না হয়। আশা নয় বিশ্বাস- অন্তবর্তীকালীন সরকার
বিজ্ঞতার ভূমিকায় বিসিএসের সৌন্দর্য বহাল রাখবে এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য
দূরীকরণের মাধ্যমে সমতা-সোহার্দ্য অটুট করবে। সবাই মিলেমিশে এই বাংলাদেশ
গড়তে হবে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি এবং আধিপত্যকামী সিদ্ধান্ত রুখে দিতে হবে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কর্মরত বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মচারীদের সম্পদ-দুর্নীতি,
ক্ষমতা-পাচারের একটা ইনডেক্স রাষ্ট্রের কাছে থাকা উচিত। যেটা সম্পর্কে
স্বাভাবিভাবে জনগণ জানবে।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
raju69alive@gmail.com

Exit mobile version