মিরপুরের বেনারশি পল্লির ব্যবসায়ী জুয়েল (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি তার মোবাইলে ফোনে দেশের বাইরের একটি নাম্বার থেকে কল আসে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের নাম ভাঙিয়ে চাওয়া হয় মোটা অঙ্কের ঈদ বকশিশ। বিষয়টি নিয়ে তিনি পরিচিত দু-একজনের সঙ্গে আলাপ করেন।
ফোনের বিষয়টিকে তারা ভুয়া বলায় জুয়েল আর থানা পুলিশের শরণাপন্ন হননি। তবে মনের ভেতর আতঙ্ক নিয়ে তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে ফার্মগেট এলাকার ফুটপাতের একজন লাইনম্যানের কাছে ফোনে চাঁদা দাবি করেন জেলে আটক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে। ঈদে তারও মোটা অঙ্কের বকশিশ লাগবে বলে আলমগীর নামের ওই লাইনম্যানকে জানান।
বিষয়টি তিনি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে জানালে তিনি চুপচাপ নিজের কাজে মন দেয়ার পরামর্শ দেন। শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়— ঈদের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট থেকে বড় মাপের ব্যবসায়ীদের কাছে এ ধরনের ফোন কলের হিড়িক পড়ে গেছে। এ ধরনের কলের যন্ত্রণায় অনেকে নাম্বারই বদল করে ফেলেছেন।
আবার অনেকে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের জানালে তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। সেখানে দেখা গেছে, বিশেষ আ্যাাপস ব্যবহার করে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে একাধিক চক্র এ ধরনের চাঁদাবাজিতে জড়াচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ-অর-রশিদ বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এসব কল দেশে বসে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে কল করা হচ্ছে। এরা সবাই প্রতারকচক্র। অনেকটা বিকাশ প্রতারণার মতো। তাদের বসবাসও ফরিদপুর, ভোলা ও জয়পুরহাটে। তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশের একাধিক টিম।
তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীর চাঁদা চাওয়া বা আদায়ের একটা ধরন আছে। এদের ক্ষেত্রে ভিন্ন। অনেকটা ছ্যাঁচড়া প্রকৃতির। এ জন্য ব্যবসায়ীদের তিনি পুলিশে জানানোর পাশাপাশি এসব কল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দখলে ছিল। তারা ঈদ বা বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করত। কোনো কারণে চাঁদা দিতে অপরাগতা জানালে গুলি অথবা বোমা হামলার নজির ছিল। বর্তমান দেশে এ ধরনের সন্ত্রীদের কোনো অস্বিত্ব নেই।
পুলিশের অভিযানে তারা অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। আবার অনেকে রয়েছেন জেলে। এর মধ্যে কয়েকজন দেশে তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ব্যবসায়ীরাও ওইসব চাঁদাবাজদের চেনেন। এ কারণে তারা সময়মতো তাদের কাছে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা পৌঁছে দেন। আবার অনেকে জেলে বসেও চাঁদা আদায় করেন।
মামলা পরিচালনার জন্য অনেক ব্যবসায়ী তাদের সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ফার্মগেট এলাকা এক সময় সুইডেন আসলামের দখলে ছিল। মগবাজারে সুব্রত বাইনের দাপট কমলেও তার সাঙ্গপাঙ্গোদের তৎপরতা এখনও চোখে পড়ে। বিশেষ করে তার ভাইরা পরিচয়ে একজন বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকে। মিরপুরে শাহাদতের এক আধিপাত্য থাকলেও শেওড়াপাড়া এলাকায় বিকাশ-প্রকাশ নতুন করে লোকজন দলে ভেড়াচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। মতিঝিল ও খিলগাঁও এলাকা জিসান ও জয়ের একক আধিপত্য রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মোহাম্মদপুরে ইমনের দাপট আরও বেড়ে গেছে। তার স্ত্রী লিনা নতুন করে চাঁদাবাজিতে জড়াচ্ছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি এসব সন্ত্রাসীদের নামের ব্যবহার বেড়ে গেছে। কারণ সামনে ঈদ। আর এ ঈদকে সামনে রেখে তাদের নাম ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের কাছে ফোন করা হচ্ছে। চাওয়া হচ্ছে ঈদ বকশিশের নামে মোটা অঙ্কের টাকা। যদিও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের কল পাওয়া মাত্রই পুলিশের শরণাপন্ন হওয়া তাগিদ দিয়েছে। তবে ভয়ে অনেকে গোপনে তাদের দাবি মেনে নিচ্ছেন বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান।
সূত্রমতে, ফোন কলের পাশাপাশি নতুন করে চালু হয়েছে সাদা কাফনের কাপড়। মোহাম্মদপুরের অন্তত একাধিক ব্যবসায়ীর কাছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবি করে কাফনের কাপড় পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করলেও বড় ভাই পরিচয় দেওয়া মূল হোতা রয়েছেন অধরা।
জানা গেছে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার ঢাকা উদ্যান এলাকায় ন্যাশনাল গ্লাস হাউস নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি প্রবেশ করেন। এরপর তার হাতে থাকা একটি চিঠির খাম, র্যাপিং পেপারে মোড়া বক্স রেখে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে ওই দোকানের লোকজন ওই খামটি খুলে দেখতে পান তাতে একটি চিরকুট রয়েছে।
ওই চিরকুটে মাত্র দুদিন সময় বেঁধে দিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। এছাড়া খামের সঙ্গে রেখে যাওয়া একটি গিফট বক্স দোকানের কর্মচারীরা দেখতে পান। ওই বক্সে তারা দেখতে পান, কাফনের কাপড়, একটি লাইফবয় সাবান, কিছু তুলা, আতরের শিশি, গোলাপজলের বোতল ও সুরমার কৌটা। এরপর কর্মচারীরা খাম ও বাক্স দোকানে রেখে যাওয়ার বিষয়টি দোকান মালিক জাহাঙ্গীর আলমকে জানান।
তিনি বিষয়টি শুনতে পেয়ে প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যান। পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে ১৬ থেকে ১৭ বছরের এক কিশোর ন্যাশনাল গ্লাস হাউসে ঢোকে। আগের মতোই সে ওই দোকানের ভেতরে একটি খাম রেখে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। তখন দোকান কর্মচারীরা দৌড়ে তাকে আটক করে। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব হোসেন নামে এক ব্যক্তি তাকে খামটি তাদের দোকানে রেখে যেতে বলেছে জানায়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের পর দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠানের মালিককে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ৩টার সময় টাকাসহ শ্যামলী ক্লাব মাঠে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
পুলিশ জানায়, তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে রাজীবের অবস্থান শনাক্তের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। এর আগে আদাবর থানার একই ধরনের কৌশলে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছে। আর তার পাঠানো চিরকুট লেখা দোকানটিও শনাক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে এখন বেশিরভাগই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ঈদ সালামি চেয়ে ফোন করছেন। তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
এছাড়া সম্প্রতি মোহাম্মদপুর থেকে অন্তত ৩৯ জন কিশোরগ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা সবাই এ ধরনের বেনামি কল দিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছিল বলে র্যাবের প্রাথমিক তদন্তে ওঠে এসেছে।