সুখ হচ্ছে শিল্পের মত। আপনি চমৎকার গাইতে পারেন কিন্তু গীতি কাউকে
শোনালেন না, অনন্য আঁকতে পারেন কিন্তু চিত্রায়ণ করে কাউকে দেখালেন না-
এসবের মূল্য আছে? একজন অসাধারণ গল্প-কবিতা লিখতে পারে কিন্তু লিখে
কাউকে পড়ালো না- লাভ কী তাতে? ভালো বলতে পারা, ভালো খেলতে পারা কিংবা
ভালো নাচতে পারা- এগুলো চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। নিজেকে নিজের মধ্যে
গুটিয়ে রাখলে প্রতিভা ক্ষয়ে যায়। সময় সবসময় সাথে থাকে না। বিচার করার,
যাচাই-বাছাইয়ের ভার কাউকে না কাউকে দিলে তবেই ত্রুটি ধরা পড়ে। সুনিপুণ হলে
প্রশংসায় হাততালি মেলে।
কেউ সুখী হতে চায় অথচ সুখ ভাগাভাগি করতে নারাজ- তবে সুখী হওয়া অসম্ভব।
নিজের সুখকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিলে তবেই সুখ আসল-মুনাফায় বাড়বে। নিজের
মধ্যে সহ্য ক্ষমতা না বাড়ালে, অল্প আঘাতে কাত হয়ে পড়লে কিংবা একটু
সমালোচনা শুনেই গুটিয়ে গেলে সুখের নাগাল মিলবে না। কখনো কখনো প্রতিক্রিয়া
চেপে যেতে হবে। অনেককিছু বলতে ইচ্ছা করছে, প্রতিবাদ জিহ্বার অগ্রে ঝুলছে-
ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেউ ভালো না বেসে আঘাত করেছে- মন থেকে সে প্রশ্ন
মুছে ফেলতে হবে। পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া না
দেখিয়ে কীভাবে রাগ-ক্ষোভ দমিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় জীবনে সে পাঠ
অর্জন করতে হবে।
জীবনটাকে সহজ করে দেখার বোধ পৃথিবীটাকে উপভোগ্য করে তুলবে। পেলাম না
কেন, দিলে না কেন?- এই প্রশ্নে রাগ দেখিয়ে দিন খোওয়ালে সময়টা অপচয় হবে।
স্বার্থ সুখের চাইতে পরার্থপরতাকে প্রধান্য দিলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে
না। সুখের সময়গুলো ভাগাভাগি করে উদযাপন করলে দুঃখের দিনেও অশুভ ছায়া
মেলবে না। তখন মেঘ কেটে যেতে সময় লাগবে না। কেউ তার কর্তব্য পালন না
করলে সে ধর্তব্য রেখে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। নিজেকে বিলিয়ে দিন,
সামর্থ্যমত সহযোগিতা করুন। ঐশ্বরিক পুরস্কারে আপনি মানসিক প্রশান্তি
পাবেন।
পেটপুরে খাওয়ার আর খাবারের স্বাদ উপভোগ করার মধ্যে তফাৎ আছে। স্থুল
সুখ অনুভূতি নষ্ট করে। জীবনে সুখ অল্প থাকুক তাও তীক্ষ্ণ থাকুক। স্বার্থপর
মানুষ প্রথম সুযোগেই সবার পর হয়ে যায় অথচ রোদ-বৃষ্টি বারবার আসবে।
অপেক্ষাতে আরও ভালো কিছু মিলবে। জীবনটাকে সকালের মিষ্টি রোদের মত
হেসে ওঠানোর জন্য, জীবন থেকে ফুলের মত সুবাস ছড়ানোর জন্য কিংবা
আলোকিত মানুষে পরিণত হওয়ার জন্য সহ্য ক্ষমতা জরুরি। ধৈর্যের ফল মিষ্ট
হয়। সুযোগ পেয়েই শোধ তুললে ক্রোধ কোনদিন কমে না।
যে বিশ্বাস রক্ষা করে তাকে মানুষ আপন মনে করে কাছে টানে। যে বিপদের দিনে
ছায়া হয় তার জন্য মায়া বাড়ে। মন খারাপের দিনে মানুষ এমন মানুষের সঙ্গ চায়
যে নিজেই চিকিৎসক আবার নিজেই ওষুধ। মন্দ দলোক কারো দোয়ায় থাকে না,
কারো মায়ায় বাঁধে না। কারো অভিশাপ-দীর্ঘশ্বাসে না জড়ালে সে মানুষ তরতরিয়ে
বড় মানুষে পরিণত হয়। সাদামাটা পোশাক, সহজ সরল চালচলনেও সবাই তাকে
দেখে শ্রদ্ধায় অবনত হয়। ভালো মানুষের কথা শুনলে সম্মান আপনাআপনি চলে
আসে।
মানসিক প্রশান্তির মত ভারী সুখ আর নাই। মানুষের প্রিয়জন হয়ে ওঠার যে
সাধনা তাতে সবাই সফলকাম হয় না। যে সয় সে আসলে পায়। কত আঘাত আসবে,
ঝড়ঝাপটা কিংবা বাঁধার পাহাড়- সবকিছু মোকাবিলা করে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেলে
পথের শেষে সুখ আছে। মুখ খারাপ করে, বকে-রেগে মানুষকে জয় করা যায় না।
জীবনে যতটুকু ভালোবাসার সঞ্চয় তা ভালোবেসেই অর্জন করতে হবে। দমিয়ে,
শাসন করে কিংবা ফাঁদে ফেলে মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য কাছে পাওয়া যায়।
অথচ মানবধর্ম যে সুখের তালাশে মশগুল তা তপস্যায় অর্জন করতে হয়। দক্ষ
শিল্পীর মত সুনিপুণ হাতে নির্মাণ করতে হয়। আত্মিক প্রশান্তির চেয়ে বড়
প্রাপ্তি আর কিছুতেই নাই।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com