মিরসরাই প্রতিনিধি
মিরসরাইয়ে টানা ভারী বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও ফেনী নদীর প্লাবনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগে পড়েন দুই লক্ষাধিক মানুষ। নষ্ট হয়েছে জমিতে আমনের বীজতলা, রোপা আউশ, রোপা আমন, শরৎকালীন সবজি, ক্ষতি হয়েছে পোল্ট্রি শিল্প। এছাড়াও ভেসে গেছে ৬’শ কোটি টাকার মৎস্য প্রকল্প। এতে পথে বসার অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের। বন্যায় মিরসরাই উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হলো করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর ও মিঠানালা।
পোল্ট্রি শিল্প
বন্যায় মিরসরাইয়ে পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। এতে অর্ধশত পোল্ট্রি খামারের লক্ষাধিক মুরগি মারা গেছে। এছাড়া ৭০ টি গরু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। পাহাড় ধসে মারা গেছে দুইটি গরু ও তিনটি ছাগল। এরই মধ্যে ২৫ টি খামারের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চিত করেছে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়, বন্যার পানি পুরোপুরিভাবে নেমে গেলে বাকি খামারগুলোর তথ্য পাওয়া যাবে।
উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের বাপ্পী পোল্ট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী জাহিদ হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘আমি ২০০৬ সাল থেকে পোল্ট্রি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমার মিরসরাই ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় ২০ টি খামার রয়েছে। এগুলোতে কাজ করে শতাধিক শ্রমিক। এবারের বন্যায় ছাগলনাইয়া উপজেলায় সাতটি ও মিরসরাইয়ে দুইটি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ নয়টি খামারে আমার ৪৬ হাজার মুরগি ছিল। তারমধ্যে মিরসরাইয়ের বেচুনি পোল এলাকায় ৪ হাজার ব্রয়লার, ছাগলনাইয়ার আলোকদিয়ায় ৫ হাজার ব্রয়লার ও ৯ হাজার ৮০০ সোনালি এবং সমিতি বাজার এলাকায় ১০ হাজার ব্রয়লার মুরগি ছিল। বিক্রয়যোগ্য এসব মুরগি বন্যার পানিতে মারা গেছে। এতে আমার প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি সিপি কোম্পানির অনুমোদিত ডিলার। ওরা আমার কাছে ১০ লাখ টাকা পাবে। এছাড়া ব্যাংক লোন রয়েছে। এখন কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবো ভাবতে পারছি না। বন্যার পর থেকে আমি শারিরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’
উপজেলার ধুম ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার খামারী কেফায়েত উল্ল্যাহ হাজারী বলেন, এবার খামারে ১১ হাজার সোনালী মুরগী তুলেছি। ৫৫ দিন বয়সী মুরগীর ওজন প্রায় এক কেজি হয়েছিল, কয়েকদিন পর বাজারে বিক্রি করার কথা। কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সব পানিতে মারা গেছে। পুঁজি হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব, প্রায় ২৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জীবনে কখনো এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখিনি। কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবো বুঝতে পারছিনা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাকিরুল ফরিদ জানান, বন্যায় উপজেলার অর্ধশত পোলট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে ২৫ টি ক্ষতিগ্রস্ত খামারের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। বন্যার পানি নেমে গেলে বাকিগুলোর তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া ৭০ টি গবাদি পশু ভেসে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
মৎস্য প্রকল্প
মিরসরাইয়ে বন্যায় ৬ হাজার একর মৎস্য প্রকল্পের ৬’শ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়। দেশের সর্ব বৃহত্তম মৎস্যজোনখ্যাত মুহুরী প্রজেক্ট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডুবে গেছে সবগুলো মৎস্য প্রকল্প। একদিকে বন্যার কবলে পড়ে ঘরবাড়ি ছাড়া অন্যদিকে ব্যবসার ক্ষতিতে বিপর্যস্ত এখানকার মৎস্য চাষীরা। চট্টগ্রামের ৭০ শতাংশ মিঠা পানির মাছের জোগান দেয় এই মুহুরি প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য প্রকল্পগুলো। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় এখানকার উৎপাদিত মাছ।
মুহুরী প্রজেক্টের চাষী ইছাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা কামরুজ্জামান দুলাল বলেন, এখানে ছোট-বড় মিলে সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। সব মাছ বন্যায় ভেসে গেছে। আমার ১০৭ একরের মতো মাছের প্রকল্প ছিল। এতে আমার বিনিয়োগ ছিল ১১ কোটি টাকা। বন্যায় আমার সবই শেষ হয়ে গেছে। এখানে ২০০ এবং ৩০০ একরে মৎস্য প্রকল্প আছে এমন চাষীও আছেন।
তিনি আরও বলেন, এখানে আমরা চাষীরা একটি ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করেছি। এরমধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতির তথ্য উঠে এসেছে। ৮ বছর ধরে আমি মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। এত বড় ক্ষতির মুখে কখনও পড়িনি।
মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় মৎস্য চাষী কামাল হোসেন, শেখ ফরিদ, ও কামরুল হোসেন জানান, বন্যার পানিতে সবগুলো মৎস্য প্রকল্প পানিতে তলিয়ে যাওয়ার মাছগুলো ফেনী নদীতে চলে যায়। এতে আমরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ জানান, বন্যায় মিরসরাইয়ের মুহুরী প্রজেক্ট ভেসে গেছে। চট্টগ্রামে অর্ধেকের বেশি মাছের চাহিদা এ প্রজেক্ট থেকে পূরণ করা হয়। এ প্রজেক্টের ৬ হাজার একর জমির জলাশয়ের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এরমধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতির তথ্য উঠে এসেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্যচাষি এবং এই খাতে জড়িত ব্যক্তিরা।
কৃষিতে ক্ষতি
বন্যায় মিরসরাইয়ে কৃষিতে ৪৮ হাজার ১৫০ জন কৃষকের রোপা আউশ ৩১০ হেক্টর, আমনের বীজতলা ৬৬০ হেক্টর, রোপা আমন ৩ হাজার ৬০ হেক্টর এবং শরৎকালীন সবজি ৯০ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কার্যালয়।
ইছাখালীর কৃষক আবুল কালাম জানান, আমার আমনের সম্পূর্ণ বীজতলা শেষ হয়ে গেছে নতুন করে বীজতলা তৈরি করলে রোপার সময় থাকবে না। এছাড়া রোপা আউশও সব শেষ। এখন কান্না ছাড়া কোন উপায় নেই।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন জানান, বন্যায় বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। উপজেলা কার্যালয়গুলোকে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে তালিকা জমা দিতে বলা হয়েছে। আশা করি ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে সরকার।
‘বিএনপি আরেকটি ১/১১ চাইছে’ বললেন উপদেষ্টা নাহিদ
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও...