জধানীর বেশিরভাগ স্থানের চিরাচরিত রূপটি সন্ধ্যা নামলেই বদলে যায় অন্য রূপে। সন্ধ্যার পর থেকে চলে একদল নারীদের প্রস্তুতি। অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে এদের তৎপরতা বাড়ে।
মূলত রাজধানীতে কয়েক ধরনের যৌনকর্মী রয়েছে। এদের মধ্যে জায়গা ও স্থান ভেদে রয়েছে পরিবর্তন। এদের মধ্যে একদল অবস্থান নেয় বিভিন্ন বাসা-বাড়ি বা আবাসিক হোটেলে। আরেক দল ভাসমান।
রাজধানী ঢাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের অন্যতম ঠিকানা সংসদ ভবন এলাকা, কারওয়ান বাজার, মতিঝিল, গুলশান, বনানী, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, বিজয় সরণি, বিমানবন্দর মহাসড়ক। তবে সম্প্রতি রাজধানীর এইসব রাস্তায় যৌনকর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে।
বিমানবন্দর এলাকায় পূর্ণিমা (ছদ্মনাম) বলেন, হতাশাগ্রস্ত হয়ে সম্প্রতি তিনি যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জানান, আমার পরিবার মনে করে আমি নাইট ডিউটিতে চাকরি করছি। কিন্তু, আসলে আমি কী করি, সেটা জানলে তারা হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু, অর্থনৈতিকভাবে আমার পরিবারকে সমর্থন করতে এটা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
এ পেশায় সদ্য আসা অনেকেই দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম ও বিশেষ কোনো দক্ষতাও নেই। সেই কারণেই তারা যৌন পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।
মূলত রাজধানীর বিভিন্ন সড়কঘেঁষে কোমরসম উচ্চতার প্রাচীরের সাথে ছোট ছোট গাছে কাপড় টেনে ঘর তৈরি করে ওরা। আর সে ঘরেই চলে রাতভর দেহ ব্যবসা।
৩৫ বছর বয়সী খাদিজা (ছদ্মনাম) জানান, তালাকপ্রাপ্ত খাদিজার ৩ সন্তান রয়েছে। এর আগে তিনি স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করতেন, যেখানে তিনি বছরে ৮ থেকে ৯ মাস কাজ করতে পারতেন। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে তিনি রাজধানীতে আসেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু, তিনি কোনো কাজ পাননি। পরিবার ও ৩ সন্তানের কথা বিবেচনা করে বাধ্য হয়েই তিনি এ পেশায় আসেন।
বিমানবন্দর এলাকায় ৩০ বছর বয়সী ভাসমান যৌনকর্মী কনিকা (ছদ্মনাম) বলেন, শ্যামলীতে এক অফিসে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে জেনেছি, ঢাকায় এখন আমাগো মতো ৪০ হাজার নঢী (যৌনকর্মী) রাস্তায় কাজ করে। তবে রাজধানীতে যৌনকর্মীর সঠিক সংখ্যা কত কিংবা তা বেড়েছে কি না, এ সংশ্লিষ্ট কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যান দিতে পারেনি ভাসমান যৌনকর্মীদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলো।
মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনিঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা “স্বর্গবেশ্যা”-দের দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন-সংসর্গে মিলিত হয়েছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই সেইসব গুণধর ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এরা মনোহর রত্ন সোনা ও মণিমু্ক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে তাঁরা রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকারে শোভিত সুন্দরী বেশ্যারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, দেবলোকেও বেশ্যাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে ত্বষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন একাধারে মদ্যপ এবং নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর উদ্দেশ্য স্বর্গজয়। স্বভাবতই স্বর্গরাজ ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে বেশ্যাদের শরণাপন্ন হলেন ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী বেশ্যাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ ইন্দ্র। মহাভারতের যুগে সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী বেশ্যাদেরকেও স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও আনন্দদানের জন্য সেনাশিবিরে এদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুই পক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র বেশ্যা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যে সব সুন্দরী “বেশস্ত্রী” অর্থাৎ বেশ্যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপরই ন্যস্ত ছিল। রামায়ণের রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী বেশ্যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রাচীন যুগে বেশ্যাদের বিবরণ বর্ণনা করতে চাইব অথচ বাৎস্যায়নে “কামসূত্রম্” উল্লেখ করব না, তা হয় নাকি ! সবার আগে সংক্ষেপে জেনে নিই কী আছে বাৎস্যায়নের “কামসূত্রম্”-এ। আছে নরনারীর কামকলার যাবতীয় তথ্য, এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর বিশদ বর্ণনা। আছে লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ও যোনির বিস্তার অনুসারে নরনারীর প্রকারভেদ, স্বভাব অনুসারে নারীর বৈশিষ্ট্য-চুম্বন-আলিঙ্গনাদি, স্তনমর্দন, দংশনক্ষত, নখক্ষত, যৌনমিলনের বিভিন্ন ভঙ্গি তথা আসন এবং প্রয়োগবিধি, পত্নী নির্বাচন, পত্নী এবং উপপত্নীর লক্ষণ, পরস্ত্রীকে বশীভূত করার উপায়, কৃত্রিম লিঙ্গের ব্যবহার, যোনির বিস্তৃতি এবং সংকোচনের উপায়, বিভিন্ন প্রকার বিবাহ, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলন, রতিক্রিয়ার উপযুক্ত স্থান প্রভৃতি। এই “কাম-সূত্রম্”-এর ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় বেশ্যাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে বেশ্যাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত বেশ্যাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বধ্যমূল ধারণার বদল হতে পারে।
বাৎস্যায়ন বেশ্যাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কাম-সূত্রমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন – “বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতিবৃত্তিশ্চ সর্গাৎ”। অর্থাৎ, “বেশ্যাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন, “রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্”। অর্থাৎ, রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে বেশ্যাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার বেশ্যাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন, “তদপি স্বাভাবিকবদ্রূপরেৎ। কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ, “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী — এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে উল্লেখ হয়েছে – “ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থম্”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলেছেন কোন্ কোন্ পুরুষ একজন বেশ্যার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় বেশ্যারা কোন্ কোন্ পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা অঙ্কের অর্থ আমদানি হবে। যেমন – (১) ধনী অথচ স্বাধীন যুবক, (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে, (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন বিকৃত বৃদ্ধ, (৪) সংঘর্ষবান, অর্থাৎ এক বেশ্যাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাকে নিতে পারে, (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন – সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি, (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে, (৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে, এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ, (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ, (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলে, (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট যুবক ইত্যাদি।
এমনকি কোন্ পুরুষদের সঙ্গে বেশ্যারা যৌনমিলন করবেন না, তারও কিছু নির্দেশিকা বাৎস্যায়ন দিয়েছেন। যেমন – (১) যক্ষ্মারোগ হয়েছে এমন পুরুষ, (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত পুরুষ, (৩) যে ব্যক্তির শুক্রের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে, (৪) কঠোর ও কর্কশ ভাষী, (৫) কঞ্জুষ বা কৃপণ, (৬) নির্ঘৃণ, (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ, (৮) চোর, (৯) বিশ্বাসঘাতক, (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ, (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে, (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।
সব ঠিক থাকলে একজন বেশ্যা (“বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎসৃজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্দধ্যাৎ”) একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে(কাম-সূত্রম ৪/৩/১)। বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন বেশ্যাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে বৃত্তির তাগিদে। এমনকি বেশ্যাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে ৬৪ কলাগুলি জেনে নিতে পারি – (১) সংগীত, (২) বাদ্য, (৩) নৃত্য, (৪) অঙ্কন, (৫) তিলক-কাটা (সেই সময়ে ললাটে-কপোলে-স্তনে, এমনকি নাভি ও হাতে-পায়ে তিলক কাটার রীতি ছিল), (৬) তণ্ডুল-কুসুম-বলি-বিকারের ব্যবহার, (৭) পুষ্পাস্তরণ ( যে বিছানায় যৌনক্রিয়া চলবে সেটি ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে), (৮) দশনবসনাঙ্গরাগ (নিজের দেহবল্লরী চিত্রিত করতে হবে), (৯) মণিভূমিকাকর্ম, (১০) শয়ন রচনা (ঋতু অনুসারে শোওয়ার বিছানা প্রস্তুত এবং সাজাতে হবে), (১১) উদকবাদ্য, (১২) উদকঘাত, (১৩) চিত্রযোগ, (১৪) মালা-গ্রন্থন-বিকল্প (মালা গাঁথা এবং তা দিয়ে সাজাতে হবে শরীর), (১৫) শেখরকাপীড়যোজন, (১৬) নেপথ্য প্রয়োগ, (১৭) কর্ণপত্রভঙ্গ, (১৮) গন্ধযুক্তি, (১৯) ভূষণযোজন, (২০) ঐন্দ্রজাল, (২১) কৌচমার যোগ, (২২) হস্তলাঘব (হাত-সাফাই বিদ্যা), (২৩) বিচিত্রশাক-যূষ-ভক্ষ-বিকার-ক্রিয়া, (২৪) সূচিবানকর্ম, (২৫) সূত্রক্রীড়া, (২৬) বীণা-ডমরুক-বাদ্য, (২৭) প্রহেলিকা, (২৮) প্রতিমালা, (২৯) দুর্বাচক যোগ, (৩০) পুস্তকবাচন, (৩১) নাটকাখ্যায়িকা, (৩২) কাব্য-সমস্যা-পূরণ, (৩৩) পট্টিকা-বেত্র-বাণ-বিকল্প, (৩৪) তক্ষকর্ম, (৩৫) তক্ষণ, (৩৬) বাস্তুবিদ্যা, (৩৭) রৌপ্যরত্ন পরীক্ষা, (৩৮) ধাতুবাদ, (৩৯) মণিরাগাকর জ্ঞান, (৪০) বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ, (৪১) মেষকুক্কুট-লাবক-যুদ্ধবিধি, (৪২) শুকসারিকা প্রলাপন, (৪৩) শরীর মর্দন, কেশ মর্দনাদির কৌশল, (৪৪) অক্ষরমুষ্টিকাকথন, (৪৫) ম্লেচ্ছিত-বিকল্প, (৪৬) নানা প্রাদেশিক ভাষায় জ্ঞান, (৪৭) পুষ্পশকটিকা, (৪৮) নিমিত্তজ্ঞান, (৪৯) যন্ত্রমাতৃকা, (৫০) ধারণমাতৃকা, (৫১) সংপাঠ, (৫২) মানসী, (৫৩) কাব্যক্রিয়া, (৫৪) অভিধানকোষ, (৫৫) ছন্দপাঠ, (৫৬) ক্রিয়াকল্প, (৫৭) ছলিতকযোগ, (৫৮) বস্ত্রগোপন, (৫৯) দ্যূতবিশেষ, (৬০) আকর্ষক্রীড়া, (৬১) বালক্রীড়নক, (৬২) বৈনয়িকী বিদ্যা, (৬৩) বৈজয়িকী বিদ্যা, (৬৪) বৈয়ামিকী বিদ্যা।বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত বেশ্যার উদ্দেশে বলেছেন – “আভিরভূচ্ছ্রিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি”।।
বাৎস্যায়নের সময় বেশ্যাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁদেরও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো বেশ্যাকেই বিয়ের পর পুরোনো বেশ্যাবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হত না। এমনকি স্বামীর দিক থেকেও বেশ্যা-স্ত্রীর বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না।অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল।বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বেশ্যাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না।তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই – এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের নিমিত্ত বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করে সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে(কাম-সূত্রম্ ৭/১/২২)।
বাৎস্যায়ন শেষ করব বেশ্যাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে – এইসব বেশ্যা বা গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝে মধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে বা যুবক খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ ? গণিকা বা বেশ্যারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যোনি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কাম-সূত্রম্ ৭/১/২০)।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতেও বেশ্যানারীর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে “মেঘদূতম্”-এ। তবে “বিক্রমোর্ব্বশীয়ম্” নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা বেশ্যারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত “স্বর্গবেশ্যা”।“নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্ত্বৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ।।/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভির্ন্নাগরানামুদ্দামানি প্রথয়তি শিলাবেশ্মভির্যোবনানি”।।– এই শ্লোকটি মহাকবির বিরচিত “মেঘদূতম্”-এর পূর্বমেঘের ২৫ অংশ থেকে উল্লেখ করা হল।
শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষসম্” গ্রন্থ থেকে জানা যায় – সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি বর্ণিত আছে। সেকালের গণিকারা যে নানা বসনেভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথ শোভাবর্ধন করতেন তারও উল্লেখ আছে। শ্রীধরদাস তাঁর “সদুক্তির্ণামৃত” গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের বেশ্যাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে “তৎকালীন” বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন “বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানাম্”।নবম শতকে রচিত “কুট্টনীমত” গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত বলেছেন, সেকালের বারানসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সে গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নাম্নী এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। “কুট্টনীমত”-ই বৃদ্ধা গণিকার উপদেশ সংবলিত গ্রন্থ।ভবভূতির “মালতীমাধব”-এ ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নাম্নী এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়েন এবং যৌনমিলন কার্য সম্পাদন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই বেশ্যারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে নাক-কান কেটে প্রেমিকা মালতীর কাছে ফিরে যান মাধব। এই হল “মালতীমাধব”-এর উপজীব্য।সপ্তম শতকের লেখক বানভট্ট তাঁর “কাদম্বরী” গ্রন্থে জানিয়েছেন, সেকালে গণিকারা দেশের রাজাকে স্নান করাত। রাজার মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজার সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত।এমনকি রাজার পরনের যাবতীয় পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতেন।“চারুদত্ত” গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনি উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। এখানে চারুদত্ত নামে জনৈক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বেশ্যা বসন্তসেনার বিয়ে হয়। এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামক বিয়ের কাহিনিও এই গ্রন্থে আছে।