রাত একটা পনেরোতে হঠাৎ এক অপরিচিত মেয়ে মেসেঞ্জারে নক করে বলল, “একটু কথা বলা যাবে?”
আমি বেশ অবাক হলাম। উত্তর দিলাম, “জি বলুন।”
মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ আমার উত্তর দেখলই না। ভাবলাম ভুলে আসেনি তো মেসেজ? অথবা হতে পারে প্রেমিকের সাথে ঝগড়া করে রাগের মাথায় মেসেজ দিয়ে বসেছিল। হুট করে পাওয়া কৌতুলহটা দমে যেতেই চোখ দুটোতে ক্লান্তি ভর করল। মোবাইল রেখে চোখ বুজলাম। ঘুমিয়েও পড়লাম দ্রুত।
সকালে উঠে দেখি চারটা মেসেজ!
“সরি, লেট হয়ে গেল রিপ্লাই দিতে!”
আমার চোখ কপালে উঠল। আমি গান গাই সেটা এই মেয়ে কেমন করে জানল? সে তো কয়েক বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। স্মৃতি হিসেবে গিটারটা আর একটা দগদগে ক্ষত রয়ে গেছে। সুরটুর কিছু গলায় আর আছে বলে মনে হয় না। লিখলাম, “গান গাইতাম৷ এখন আর অভ্যাস নেই।”
অফিসে সারাদিন ব্যস্ত থেকে মেয়েটার কথা মাথাতেই ছিল না। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে মেসেঞ্জার চেক করতেই দেখলাম উত্তর এসেছে- “আপনার একটা গানের ভিডিও আমার কাছে আছে। খুব ভালো লাগে শুনতে।”
মনে পড়ল আগে গান গেয়ে সেটা ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করতাম। কিন্তু সেই আইডি তো ডিএক্টিভ! জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি ভিডিও পেলেন কোথায়? আপনি কি আমাকে চেনেন?”
মেয়েটা এখনো লাইনে নেই। আমি আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বাসায় ফিরে দেখি মা অসুস্থ। প্রেশার কমে মাথা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। সেদিন তো বটেই, পরের দিনও মাকে নিয়েই পড়ে রইলাম। পরদিন রাতে একটু সময় পেলে ফেসবুকে লগইন করলাম। মেয়েটার মেসেজ দেখে ওর কথা মনে পড়ে গেল। লিখেছে- “আমি আপনার বিভাগের জুনিয়র ছিলাম।”
মেয়েটা অনলাইনে ছিল। সে ব্যাচ বলল। দেখলাম চার বছরের ছোট৷ নামটা অচেনা। শৈলি। এই নামের কাউকে চিনি বলে মনে হলো না। প্রোফাইলের ছবিটা বড় করে দেখলাম। নাহ! চেনা লাগে না। তবে মুখটা খুব মিষ্টি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
বললাম, “চিনতে পারছি না। সরি।”
“ইটস ওকে। আপনি গত দুই দিন ফেসবুকে একদম আসেননি।”
আমি বিস্তারিত বললাম। শৈলি তারপর কথা চালিয়ে গেল। আমি শুধু উত্তর দিলাম। নিজে থেকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। বুঝলাম সে আমাকে পছন্দ করে। সরাসরি বলতে পারছে না। নইলে কোনো মেয়ে যেচে পড়ে এত আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু সে ভুল পথে এগুচ্ছে। ও তো জানে না আমার জীবনে প্রেম ভালোবাসা সংক্রান্ত সব আবেগ মরে ভূত হয়ে গেছে!
জীবনের সবটা দিয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম সে যখন সামান্য একটু বেশি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় অন্য লোককে বিয়ে করে নিয়েছে তখনই বিশ্বাস নামক কাচের জারটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তাও তো বছর তিনেক হলো।
মা বিয়ে করতে বলছে। জায়গায় জায়গায় মেয়ে দেখছে। আমি এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু জানি বেশিদিন পারব না। বিয়ে করা দরকার। মা একা পেরে ওঠে না। সংসার, সন্তানের কথা ভাবলে মনে হয় বিয়ে করা প্রয়োজন। একা একা সারাজীবন থাকাটা অনেকটা বোঝার মতো।
শৈলি অনেকদিন আকারে ইঙ্গিতে আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলল। আমি কোনো সাড়া দিলাম না। একদিন সরাসরি বলে বসল, “আপনাকে কিছু বলব।”
বলেই মেয়ে অফলাইন। তিনদিন দেখা নেই। আমিও উত্তর দিলাম না। চতুর্থ দিন তাকে অনলাইনে পাওয়া গেল। আমার উত্তর না পেয়ে নিশ্চয়ই খুব অপমান বোধ হয়েছে। হ্যাঁ বা না কিছু বলা উচিত ছিল। নিজেরই খারাপ লাগল। মেসেজ দিলাম- “প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই। বিয়ে করবে? “
মেসেজটা সিন হলো সাথে সাথেই। তারপরেই শৈলি আবার অফলাইন। তিনদিন পর সে এলো। তখন আমি অফিসে। মেইল চেক করতে গিয়ে মেসেজটা চোখে পড়ল- “আমি রাজি। বাসায় বলেছি। তারা আপনার মায়ের সাথে কথা বলেছে।”
এমন করিৎকর্মা মেয়ে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মুচকি হাসলাম। দেখা যাক কী হয়।
কেমন কেমন করে বিয়েটাও হয়ে গেল। বিয়ে হলো ভর দুপুরে। কোনো অনুষ্ঠান না, ঘরোয়া বিয়ে। বিয়ের দিন সন্ধ্যার টিকিট কাটা হলো কক্সবাজারের৷ বিয়ের পর মাত্র দশ মিনিট আমরা এক ঘরে একা রইলাম। শৈলির চোখদুটো ঝলমল করছে। খুশি উপচে পড়ছে ঠোঁটের কোণ বেয়ে। বলল, “আপনাকে এত সহজে পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি!”
আমার দারুণ অবাক লাগল। আমাকে পেয়ে এত আনন্দ! আর এই আমাকেই একজন পায়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল।
কক্সবাজার পৌঁছুলাম মাঝরাতে। শৈলির অনুরোধে খুব ভোরে সমূদ্র দেখতে বের হয়ে গেলাম। আসার পথে শৈলি অনেক কথা বলেছে। ইউনিভার্সিটিতে আমাকে দেখার কথা, আমার ফেলে আসা প্রেমের ব্যাপারে জানার কথা, তার ভালোবাসার কথা, অপেক্ষার কথা। আমি শুধু শুনে গেছি। ধারণা করেছিলাম এমনটাই।
বিশাল সাগরের স্নিগ্ধতা শরীর মনের ক্লান্তি শুষে নিল। চোখ বুজে সাগরের নোনা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। শৈলি পাশেই দাঁড়িয়ে। আমার একটা হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল। সূর্য তখনো ওঠেনি। আমার ইচ্ছে করছে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকতে। শৈলিকে মনে হলো উটকো ঝামেলা। এখুনি বকবক শুরু করবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ আমার কাঁধে মাথা রেখে সমূদ্র দেখতে থাকল। সূর্য যখন পুরো আকাশ জুড়ে আবির রঙা আলো ছড়িয়ে ওপর দিকে উঠছে, ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের পায়ের কাছে এসে, ও হঠাৎ সরে গেল। উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে থাকল দূরে…
মনে হলো কী যেন খালি খালি লাগছে। ও থাকার সময় বুক ভরা ছিল, হঠাৎ শূন্য হয়ে গেছে। শূন্য জায়গা দ্রুত ভরাট করে নিচ্ছে হাহাকার। আমার কেমন অস্থির লাগতে শুরু করল। চিৎকার করে ডাকলাম, “শৈলি!”
শৈলি পেছন ফিরল৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে। তখনো মানুষজন তেমন নেই আশেপাশে৷ বাতাসে শৈলির আসমানী রঙা ওড়ানটা পতাকার মতো উঠছে। ওকে কাছে টেনে নিলাম। ওর মাথাটা আমার কাঁধে ফেলে বললাম, “থাকো এভাবেই।”
শৈলি খিলখিল করে হেসে উঠল।
Post Views: 299
Like this:
Like Loading...
Related