সম্পর্ক টিকে থাকে জটিল সময়ে ধৈর্য ও ভালোবাসায়
একবার এক দম্পতিকে জিজ্ঞাসা করা হলো তারা কীভাবে একসাথে ৬০ বছর কাটিয়েছিলেন। তারা উত্তর দিয়েছিলেন, আমরা যে সময়টাতে জন্মেছিলাম তখন কোন কিছুতে সমস্যা দেখা দিলে তার মেরামত করে সারিয়ে নিতাম, ছুঁড়ে ফেলে দিতাম না।
আপনাদের সম্পর্কটি খেয়াল করুন। দেখবেন প্রতিদিনই হয়ত নিত্যনতুন কিছু সমস্যা আসবে। কিন্তু আল্লাহকে স্মরণ রেখে, তার কাছে সাহায্য চেয়ে বিষয়গুলো দু’জনে মিলে আলাপ করুন। ভালোবাসার এই সম্পর্কটিতে অপরজনের কাছে ছোট হবার মতন কিছু নেই কেননা সংসার আপনাদের দু’জনের মিলেই। আপনিই বরং আগে ক্ষমা চেয়ে নিন, তার প্রতি আপনার ব্যাকুলতার কথাটি বোঝান। আপনি ভালো থাকা মানে তিনি ভালো থাকা, তার ভালো থাকাও আপনার ভালো থাকা।
সমস্যা হলে সমাধান করার কথা ভাবুন। দেখবেন ভালোবাসা আর আন্তরিকতা দিয়ে যেকোন পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারবেন দু’জনের মাঝে। শয়তান খুবই খুশি হয় দাম্পত্য সম্পর্কে অশান্তি তৈরি করতে পারলে। খেপে যাবেন না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান, মাথা ঠান্ডা রাখুন। ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। দেখবেন ছোট ছোট সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে আপনার স্বামী/স্ত্রীকে আপনি আরো বেশি ভালোবাসবেন। আল্লাহ আমাদের পরিবারগুলোতে শান্তি দান করুন।
সংসারে ভালোবাসার বন্ধন
আপনি যখন আল্লাহকে খুশি রাখতে আপনার স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসবেন, তখন আপনি কিন্তু সে কেমন করে রেস্পন্স করছে আপনার কেয়ারগুলোর, আপনার ভালোবাসাটুকুর, আপনার আবেগ আর সচেনতনতাটুকুর — সেটা হিসেব করবেন না। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন যে তা কোন ফিডব্যাক দাবী করে না। রিপ্লাই আশা করলে সেটা তখন “বিনিময়” হয়ে যায়। আপনার প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসুন আপনার নিজের জন্যই। তবে এটা ঠিক, আল্লাহর জন্য যখন কাউকে ভালোবাসবেন, তখন আল্লাহ আপনার অন্তরে প্রশান্তি দিবেন। হয়ত তিনি আপনাদের হৃদয়ে এমন ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে দেবেন যা শতবর্ষ চেষ্টাতেও কারো তৈরি করা সম্ভব হয় না।
মনে রাখবেন, ভালোবাসা সৃষ্টির মালিক আল্লাহ। তিনিই হৃদয়গুলোতে ভালোবাসার বীজ বপন করে দেন, অতঃপর তাকে বেড়ে ওঠান। ভালোবাসার বন্ধনগুলোর মাঝে আল্লাহ থাকুক কেন্দ্রবিন্দুতে। তাহলে খুব ভালো সময়টাতেও আপনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন, আবার টানাপোড়েন চলে আসলেও আপনি আঘাতে ও কষ্টে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে যাবেন না, আল্লাহর উপরেই নির্ভর করবেন। যিনি কঠিন সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখেন, তিনি কম ক্ষতিগ্রস্ত হন। ধৈর্যশীল মানুষরা জানেন এই সময়টা কেটে গেলেই তিনি আবার সব গুছিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন। আল্লাহ গাফুরুল ওয়াদুদ, তিনি প্রেমময় ও ক্ষমাশীল। আল্লাহ যেন আমাদের সংসারগুলোতে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেন।
দাম্পত্য জীবনের প্রদর্শনী সোশাল নেটওয়ার্কে করবেন না
আপনার দাম্পত্য জীবনের সুখের প্রদর্শনী অনুগ্রহ করে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতন সোশাল ওয়েবসাইটে করবেন না। নিজেদের আনন্দের সময়ের ছবি আপলোড না করাই উত্তম। আপনার আনন্দ-ভালোলাগা-সুখকে নিজেদের মাঝেই রাখুন, দু’জনে মিলেই উপভোগ করুন। মনে রাখবেন, মানুষের বদনজর তখন কিন্তু আপনার দিকে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। বদনজরের ব্যাপারটা কিন্তু সত্য। আশা করি আগ্রহ করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে চান না…
একইভাবে আপনার লাইফ পার্টনারের খারাপ বিষয়গুলো সরাসরি বা আকারে ইংগিতে ফেসবুকে-টুইটারে উল্লেখ করবেন না। শয়তান আপনার এই কাজটুকুকে কতভাবে যে টুইস্ট করে অন্যের মনে ঢুকিয়ে আপনার জীবনে একে বড় দুর্যোগে পরিণত হবার কারণ করতে পারে। সোশাল নেটওয়ার্কে দাম্পত্য বিষয়গুলো উল্লেখ করার আগে অনেকবার ভেবে নিন। দায়িত্বহীন কাজের ফল মানুষকে ভোগ করতেই হয়।
অন্যদের সামনে স্ত্রীকে বা স্বামীকে অপমান করবেন না
অন্যদের সামনে স্ত্রীকে বা স্বামীকে অপমান করবেন না। তার অসম্মান হয় এমন কথা সবার সামনে বলবেন না। মনে রাখবেন, তিনি আপনার দ্বীনকে পূর্ণ করেছেন। তিনি আপনার সংসারের সহযোগী, সহযাত্রী, বন্ধু। তার অসম্মান হলে বা সম্মানহানি হলে সেই কালিমা আপনার গায়েও এসে লাগবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তাদের প্রতি আমরা হিংষা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ না করি তা শিখিয়েছেন।
ইগো বা অহংকার সংসারকে ধ্বংস করে
আপনার স্বামী বা স্ত্রী হয়ত আপনার সাথে এমন কথা বলেছেন কিংবা আচরণ করেছেন যা আপনার বেশ গায়ে লেগেছে, তবু যখন আপনি রাগ দেখিয়ে, জেদ প্রকাশ করে তাকে পালটা আহত করছেন না — এর অনেকগুলো কারণের একটি হলো, আপনাদের সম্পর্কটাকে আপনি আপনার অহং বা ইগোর চাইতে উপরে স্থান দিচ্ছেন।
অভিজ্ঞরা বলেন, বেশিরভাগ দাম্পত্য সম্পর্কের ফাটল দেখা দেয় মূলত সূক্ষ্ম কিছু অমিল আর ঘটনাকে কেন্দ্রে করে যা বিবর্ধিত হতে হতে ভয়াবহ আকার ধারণ করে যার একটি প্রধান কারণ অহংবোধ বা ইগো।
সমাধানের আগ্রহ নয়, দু’জনার সম্পর্কটাকে বড় করে দেখা নয় বরং যখন নিজেকেই বেশি বড় করে দেখা হয়, তখন সম্পর্কে বিষ ঢুকে পড়ে। অহংবোধ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমস্যাগুলোর সমাধানের আগ্রহটুকুও নষ্ট করে ফেলে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদেরকে অহংবোধ থেকে মুক্তি দিন, জীবনসঙ্গীর প্রতি আন্তরিকভাবে কর্তব্য করে যাওয়া, দু’জনে মিলে সংসারটিকে সুন্দর করে গড়ে তোলার ও নিজেদের মাঝে সহমর্মিতা গড়ে তোলার তাওফিক দিন।
সম্পর্ক ও তর্ক
যারা নিজেদের সম্পর্ক ভেঙ্গেচুরে হলেও তর্কে জিততে চায় তারাই সবচাইতে বোকা ও অপরিণত মানুষ। যারা তর্কে হেরে হলেও নিজেদের সম্পর্ককে উপরে তুলে রাখে তারাই বুদ্ধিসম্পন্ন ও পরিণত মানুষ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের এমন জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনী দান করুন যারা আমাদের চোখের জন্য শীতলতাকারী হবে, আমাদের প্রশান্তি আনয়নকারী হবে। আমিন।
শেয়ারিং
জীবনের অনেক বিষয়েই জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীর উপরে নির্ভর করা, তার সাথে শেয়ার করার ব্যাপারটা ভালো, সেটাই স্বাভাবিক। যখন আপনি আঘাতগ্রস্ত, আপনার হৃদয় ভারাক্রান্ত, আপনি একটু দ্বিধায় আছেন, বিপদে আছেন — আপনার জীবনসঙ্গীর কাছে কথাগুলো খুলে বলা আপনার ভারকে হালকা করবে, এটাও ঠিক। কিন্তু সত্যি কথা হলো, সমস্ত ক্ষত, ব্যথা, বিপদ, যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব, অশান্তি থেকে মানুষকে মুক্ত করার একমাত্র ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার হাতেই। জীবনসঙ্গী আপনার সাথে থাকবেন, আপনাকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিতে পারবেন, আপনার ভালোর জন্য প্রাণভরা চাইতে পারবেন ঠিকই — কিন্তু কল্যাণ ঘটানোর, উন্নতি আর মুক্তি দেওয়ার মালিক একমাত্র আমাদের রব, আমাদের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা…
দ্বীনের অর্ধেক
আপনার জীবনসঙ্গী কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ নন, সেটা আশা করাও উচিৎ নয়। কল্পনার নায়ক বা নায়িকা যাকে অনেক মানুষ গড়ে তোলে ছোটবেলা থেকে, তার সাথে বাস্তব কখনো মিল হয় না। আপনার স্বামী বা স্ত্রী একজন মানুষ, যিনি তার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন আপনার সাথে বন্ধন গড়ে। আপনি তার পোশাকের মতন, তিনিও আপনার জন্য তেমন। দু’জনের বন্ধন একে অপরের পরিপূরক হবার মাঝে। কিন্তু কখনো ভাববেন না তিনি হবেন ‘পরম ও পরিপূর্ণ’।
মানুষটার কথা শুনুন মন দিয়ে। আপনার সাথে দেখা হবার আগে তার একটা জীবন ছিলো — আপনার মতই যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা, অনেক অনুভূতির, অনেক স্পর্শকাতরতার, অনেক তিক্ত আর মধুর স্মৃতিভরা। তার জীবনটাকে শ্রদ্ধা করুন। শ্রদ্ধা ও সম্মান পাওয়ার শর্তও পৃথিবীতে তেমনি — আগে নিজেকে করতে হয়। আপনার জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনী আপনার কারণে, আপনার অস্তিত্বের অনুপ্রেরণায় জগতের আর সব অশ্লীলতা থেকে সরে আছেন, থাকবেন — তার প্রতি কোমল হওয়াও প্রয়োজন।
আমাদের ভালোবাসাগুলো কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় দেখা বিশাল বিশাল বিষয়ের মাঝে নয়, বরং জীবনের নিত্যদিনের ছোট্ট ছোট্ট হাসির মাঝে, ভালোবাসার দু’টি বাক্যের মাঝে, অন্যের জন্য মন-শরীর-হৃদয় দিয়ে করা কাজগুলোর মাঝে জড়িয়ে থাকে। ভালোবাসুন, ভালোবাসাও কিন্তু এই জীবনযুদ্ধের প্রাত্যহিক কষ্টগুলোরই একটা অংশ।
কোমল ব্যবহার অপরিহার্য
জীবনসঙ্গীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা করুন, তিনি প্রতিদিন আপনার জন্য কত কিছু করছেন যা হয়ত সবই তার দায়িত্ব নয়। আপনার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি শ্রম দিচ্ছেন, আপনার সন্তান ও আপনার আব্বা-আম্মার প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্য পালন করছেন। এই মানুষটা অবশ্যই আপনার সুন্দর ব্যবহার পাওয়ার দাবী রাখেন। রাগ হলে সংযত করে ফেলুন, বিরক্ত হলে তার সুন্দর গুণগুলোর কথা ভাবুন, এরপর আন্তরিকভাবে তাকে বলুন কেমন করলে আপনাদের সংসারটা আরো সুন্দর হবে।
আমাদের ঈমানকে পূর্ণাঙ্গ করতে নম্র ও কোমল ব্যবহার থাকা অপরিহার্য এবং অত্যাবশ্যকীয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের মানুষটি এরকম সুন্দর বিষয়ই জানিয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
♥ “যার চরিত্র যত সুন্দর এবং নিজ পরিবারের সাথে যার ব্যবহার যত নম্র ও কোমল, তার ঈমান ততই পূর্ণাঙ্গ এবং পরিপক্ক।” ♥
[তিরমিজী, হাকেম]
জীবনসঙ্গিনীর গায়ে হাত কখনো তুলবেন না
যতই রেগে উঠুন জীবনসঙ্গিনীর গায়ে হাত কখনো তুলবেন না। এটা কাপুরুষতার লক্ষণ এবং বড় অন্যায়। এই মানুষটাই আপনাকে কত ভালোবাসায় সিক্ত করেন, তা মনে রাখবেন। সুন্দর করে বলুন, বুঝিয়ে বলুন। সে বুঝবে ইনশাআল্লাহ।
সত্য কথা বলা
আপনার জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনীকে কোন সত্য কথা বলা যদি অস্বস্তিকর হয়েও থাকে, তবু মিথ্যা বলার চেয়ে তা উত্তম। একটা কথা ভেবে দেখুন, আমাদের সম্পর্কগুলোর মূলে কিন্তু বিশ্বস্ততা আর পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ। আপনার স্বামী বা স্ত্রী যদি আপনার সাথে সত্য বলেন সবসময়, আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন — আপনাদের সম্পর্কে চিড় ধরবে না ইনশাআল্লাহ, শয়তান আপনাদের মনে সহজে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারবে না।
মিথ্যা বলা একটি পাপ, আর প্রতিটি পাপ আরো অনেকগুলো পাপের জন্ম দেয়। এভাবে একটা মিথ্যা কথা আমাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, জীবনসঙ্গী তো বটেই। আসুন, একটু অস্বস্তি, বিব্রতবোধ হলেও সত্য বলা থেকে আমরা পিছপা না হই। আল্লাহ আমাদের পরিবারগুলোর মাঝে রাহমাত দান করুন।
কোমলতা
দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার প্রকৃত পরিচয় ব্যবহারে। আপনার জীবনসঙ্গীর প্রতি আপনি কতটা কোমল, মিষ্টভাষী — তার মাঝে আপনার চরিত্রের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। দেখবেন, আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী আপনার কোমল কন্ঠের ভাষাটাই বেশি ভালবাসেন। রাগ দেখাবেন না, রূঢ় ভাষা সংযত করুন — এগুলো সম্পর্ককে ধ্বংস করে। আন্তরিকভাবে এই চেষ্টা করা উচিত। একদিনে হয়ত পারা যায় না, কিন্তু এই ইচ্ছেটা আপনার আচরণগুলোকে সৌন্দর্যময় করতে পারে, ধীরে ধীরে আপনার ব্যবহার সুন্দর হয়ে উঠবে ইনশা আল্লাহ। কোমল আর বিনয়ী মানুষকে কেউ ভালো না বেসে পারে না। আপনার ভালোবাসার প্রকাশটাই আপনাকে ভালোবাসা এনে দিবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোমলচিত্ত, তিনি সবকিছুতে কোমলতাকে পছন্দ করেন।