পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন হয়ে ওঠে ‘ফাগুয়া পরব’ বা উৎসব। জাত-পাত, ধনী-গরীব, বর্ণ-গোত্রভেদে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসতে এই উৎসবের জুড়ি মেলা ভার। এদেশে ভিন্ন-ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মানুষ আবহমান কাল থেকে বসবাস করে আসছে। তাঁরা তাদের স্বকীয়তা ধরে রাখবার পাশাপাশি শত-শত বছরের সংস্কৃতির ধারণ, লালন ও বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত অবদান রাখছেন। সমৃদ্ধ করছেন দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ভা-ারকে।
উৎসবপ্রেমী বাংলাদেশে ‘ফাগুয়া’ অন্যতম এক উৎসব। যা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্ণাঢ্যভাবে পালিত হয়। এটি মূলতঃ ফাল্গুন মাসের উৎসব, যা নামকরণের সাথে প্রাসঙ্গিক। উৎসবটি অনেকটা অভিন্ন ধাঁচের হলেও নামের যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। ফাগুয়া, ফগুয়া, রঙ পরব, হোলী, দোল অথবা লালপূজা যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন উৎসবের তাৎপর্য বা মাহাত্ম কাছাকাছি। উড়াও, রবিদাস, মুন্ডা, নুনিয়া, রাজভর, গঞ্জু সিং, মাহাতো, বাঁশফোরসহ অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ‘ফাগুয়া’ বর্ণাঢ্যভাবে পালিত হয়ে থাকে। রবিদাস জনগোষ্ঠীর মধ্যে এদিন ঘারকা দেওতা (ঘরের দেবতা) এর উদ্দেশ্যে আবির ও কাঁদা উৎসর্গ করে পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। এসময় বড়দের প্রণাম করে ছোটরা আশির্বাদ নিয়ে থাকে।
হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব হিসেবে ‘দোলযাত্রা’ পালিত হয়ে থাকে। বসন্তোৎসব’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। দোলযাত্রা হয় ফালগুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল যাত্রায় রঙ খেলা হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রঙ খেলায় মাতেন। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
চা বাগানের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব ফাগুয়ারা। বিশেষত এ উৎসবটি ঘিরে চা-শ্রমিকরা বর্ণিল হয়ে ওঠেন। ফাগুয়াকে বলা চলে চা-শ্রমিকদের প্রধান ও প্রাণের উৎসব। সবুজ চা বাগানের শ্রমিকদের জীবন অনেকটাই অবহেলা ও বঞ্চনায় ভরা। নামমাত্র মজুরী দিয়ে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করাই যেখানে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে আনন্দোৎসব অনেকটাই বিলাসিতা বলা চলে। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তাদের অবহেলিত জীবনে অন্যতম উৎসব রঙ পরব বা ফাগুয়া উৎসব। এ উৎসব যেন সকল সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নেয়।
চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা। তবে ফাল্গুনের এই ‘ফাগুয়া’ (লাল পূজা) উৎসবে বাগানে সবাই একত্রিত হয়ে এক রঙের উৎসবে পরিণত করেন। চা-শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবনে প্রতিবছর ফাগুয়া উৎসব আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। ফাগুয়া শুরু হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েরা বাপের বাড়ি নাইওরে আসেন। চা-বাগানের ঘরে ঘরে ভালো রান্নাবান্না হয়। অনেক আনন্দ হয়।
ফাগুয়াতে সবার হাতে কিংবা মুখে লাগানো হয় বিভিন্ন ধরনের রং। যাঁদের মুখে রং নেই, তাঁদের রং দিয়ে রাঙিয়ে তুলতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ অন্যজনের। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর সবাই নেচে গেয়ে আনন্দ উদযাপন করেন। ছোট শিশুরা পানির সঙ্গে রঙ মিশিয়ে একে অন্যের দিকে ছিটিয়ে দেয়। চা-বাগানগুলোতে শুরু হয় লাঠিনাচ। ফাগুয়া উৎসবের তিন দিন চা জনগোষ্ঠীর লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করে। চা বাগানের শ্রমিক কলোনিতে বেজে উঠে মাদলের ধিতাং ধিতাং তাল। মাদলের তালে কাঠি হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় কাঠি নৃত্যের দল। চা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির গান, কাঠিনৃত্য, ঝুমুর নৃত্য, দ- নাচ, ঘটি নৃত্যের অনুষ্ঠান হয়। পত্রসওরা, নৃত্যযোগী, চড়াইয়া নৃত্য, ঝুমর নৃত্য, লাঠিনৃত্য, হাড়িনৃত্য, পালা নৃত্য, ডং ও নাগরে, ভজনা, মঙ্গলা নৃত্য, হোলিগীত, বীরহা, করমগীত একসঙ্গে উপভোগ করতে দেখা যায় এসময়।
চা-শিল্পাঞ্চলে ফাগুয়া উৎসবের প্রথম দিনে বা আবিরের দিন থেকে শ্রমিকরা শুকনো রঙ দিয়ে একজন আরেকজনকে রাঙিয়ে তুলতে থাকেন। পরের দিন বাগানে বাগানে শুরু হয় রাধা-কৃষ্ণের কীর্তন। বাগানের নারী-পুরুষ সব শ্রমিকই কীর্তনে যোগ দেন। পরের দিনও চলে রঙের খেলা। চা-শ্রমিক মেয়েরা এদিন রাধার সাজে পোশাক অলংকার পরে এবং ছেলেরা কৃষ্ণ সেজে উৎসবে যোগ দেন। প্রতিটি চা-বাগানে ১০ থেকে ১২ জনের একটি করে দলের প্রত্যেক সদস্য দুই হাতে দুটি ছোট লাঠি নিয়ে লাঠিনৃত্যে অংশ নেন। দলের মধ্যে যে কৃষ্ণ সাজেন, তার হাতে থাকে বাঁশি। শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তারা লাঠিনৃত্য করে থাকেন। বাগানে এই লাঠিখেলা নৃত্য একমাত্র ফাগুয়া উৎসবেই হয়ে থাকে। চা-শ্রমিকরা লাঠি খেলার সময় ওড়িশা, বাংলা ও হিন্দি গান গেয়ে মাদল, বাঁশি ও লাঠির শব্দের তালে তালে মুখরিত করে তোলেন চা-শ্রমিক পল্লীগুলো। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ চা-শ্রমিকদের প্রাণের উৎসব, প্রেমের উৎসব ফাগুয়া দেখতে চা-বাগান এলাকায় ভিড় করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফাগুয়ার উৎসবে একাত্ম হন সবাই।
উড়াও আদিবাসীদের মধ্যে ফাগুয়া বেশ জনপ্রিয় উৎসব। প্রতি বছরই সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, মাহালী, মাহাতো, মালপাহাড়িয়াসহ অন্যান্য আদিবাসী জাতিসত্তার আদিবাসীরাও এ উৎসবে অংশ গ্রহন করে। তাদের উপস্থিতিতে আদিবাসীদের সৌহার্দ-সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিণত হয়। ফাগুয়া উৎসব উপলক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি গ্রহন করা হয় তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, ফাগুয়া পূজা, আদিবাসীদের নাচ-গান, ওরাওঁদের সাদরি ভাষার নাটক মঞ্চস্থ ও আলোচনা সভা।
মুন্ডা জনগোষ্ঠীও পালন করে ‘ফাগুয়া উৎসব’। আদিবাসী পল্লীতে এ উৎসব পালিত হয়। এ সময় মুন্ডা সম্প্রদায়ের সব বয়সি নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এ উৎসবে মেতে ওঠেন। উৎসবের শুরুতে খোলা স্থানে খড়কুটো ও গাছের ডালের সমন্বয়ে একটি ঘরসদৃশ স্থাপনা তৈরি করা হয়। পরে সম্প্রদায়ের পুরোহিত সেখানে পূজা-অর্চনাশেষে ওই স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেন। স্থাপনায় দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেলে সেখানে উপস্থিত সবাই ওই স্থাপনাকে লক্ষ্য করে মাটির ঢিল নিক্ষেপ করতে থাকেন। পরে সেখানে উপস্থিত সবাই একে অপরকে আবির ও রঙ মাখিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। এ ছাড়া উৎসবের অংশ হিসেবে তরুণরা ‘বুন্দিয়া খেলা’য় (কেরোসিন মাখানো কাপড়ের বল বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে শূন্যে ছোড়াছুড়ি খেলা) মেতে ওঠেন।
যথাযথ উদ্যোগ, চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের অনেক কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। ফলে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি হারিয়ে যাচ্ছে। যা সমাজ প্রগতির পথে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখে। এই ধরনের উৎসব পালন আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চেতনাকে আরও মজবুত করে তোলে। এই বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি-সংস্কৃৃৃতি যেন কোনোভাবে বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এখনই। এটি আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, অদম্য যুব ফোরাম।