অধুনা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে একটি সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এটি হলো
কিশোর অপরাধ। কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদকসেবন, ইভটিজিং (Eve-teasing) ইত্যাদিসহ এমন সব ভয়াবহ কাজ করছে, এমন সব অঘটন ঘটিয়ে চলছে এবং এমন সব লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে যা কি না অকল্পনীয়। বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষের যুগে আমাদের আগামী দিনের আশা ভরসার স্থল কিশোরসমাজের এ ব্যাপক বিপর্যয় সত্যিই বড় দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ সর্বনাশা ছোবল থেকে আমাদের কিশোর-কিশোরীদেরকে রক্ষা করতে হবে।
কিশোর অপরাধচিত্র
১৯৯৪ সালে ইলিশিয়াম ভবনে স্কুল বন্ধুদের দ্বারা দশম শ্রেণীর ছাত্র ঈশা (১৫) হত্যাকাণ্ড ঘটে। গ্রেফতার হয় ঈশার বন্ধু প্রিন্সসহ ৫ কিশোর। খুন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিশোরটি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নীল ছবি দেখছিল। ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অথচ এ ঈশাই মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার মাকে বারবার আর্তনাদ করে বলছিল মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, আমি একা বাসায় থাকতে পারছি না।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সম্প্র্রিতিক ও নিকট অতীতের আরও কিছু অবাক করা ঘটনা
ক. ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের তাসনুভা নামে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সে আত্মহত্যা করে বলে কলেজ কর্র্তৃপক্ষের ধারণা। তার বাড়ি কুষ্টিয়াদের। তাসনুভার বাবা মো: একরাম একজন এনজিও কর্মকর্তা। গতকাল তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
(দৈনিক আমাদের সময়, ৩০.১১.২০০৮)
১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সন পর্যন্ত এই ৫ বছরে পুলিশের ডায়েরি মতে, শুধু ঝিনাইদহ জেলায় ৬১ জন শিশু, ১৯১ জন কিশোর ও ৪৩৬ জন কিশোরী অত্মহত্যা করে। দৈনিক ইতেফাক, ২২. ৩. ১৯৯৫ ।
খ. কোতোয়ালী থানা পুলিশ গত ১৫ই জুলাই পাট গুদাম হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র নাজমুল হাসান বাবু (১২) হত্যা রহস্য উদঘাটন এবং হত্যার সহিত জড়িত একই মাদ্রাসার ছাত্র হামিদুল ইসলাম (১৪) ও আবদুর রহমান মুন্না নামের অপর এক কিশোরকে গ্রেফতার করিয়াছে। পুলিশ নিহত বাবুর অপহৃত সাইকেল ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা উদ্ধার করিয়াছে। উল্লেখ, গত ১২ই জুলাই রাত্রে শহরের কেওয়াটখালী নিবাসী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসর এমরান হোসেনের পুত্র নাজমুল হাসান বাবুকে জবাই করিয়া হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ধৃত কিশোরদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, নিহত বাবু গত ৫ জুলাই পাট গুদাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা হইতে হেফজ সম্পূর্ণ করায় তাহার পিতা তাহাকে একটি সাইকেল কিনিয়া দেয়। বাবু সাইকেল লইয়া রাস্তায় বাহির হইলে তাহার সহপাঠী কোতয়ালী থানার চর নিকলিয়ার হামিদুল ইসলাম চালানোর জন্য বাবুর নিকট সাইকেলটি চায়। বাবু সাইকেল না দেয়ায় উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাবু হামিদুলকে চপেটাঘাত করে। হামিদুল তাহার বন্ধু কোতয়ালী থানার মড়াখোলার আবদুল জলিলের পুত্র আবদুর রহমানকে ওরফে মুন্নাকে ঘটনা অবহিত করে এবং বাবুকে মারিয়া ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত ১২ ই জুলাই রাত্রি সাড়ে আটটায় তাহার এক বাড়িতে কুরআন খতমের দাওয়াতের কথা বলিয়া একই সাইকেলে তিনজন রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে পাওয়ার হাউজের দৌয়ালের পার্শ্বে হামিদুল অতর্কিত বাবুকে জাপটাইয়া ধরিয়া মাটিতে ফেলিয়া দিয়া দুইজন মিলিয়া দা দিয়া তাহাকে জবাই করিয়া ফেলিয়া রাখে। ঘটনার পর হমিদুল ও মুন্না সাইকেলযোগে চলিয়া যায়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮.০৭.১৯৯৬)
গ. পকেটমার আরিফ হোসেন (১৬) বয়সে কিশোর হলে কাজে সে ভয়ঙ্কর। চার বছরে শতাধিক মোবাইল ফোন সেট চুরির অভিজ্ঞতা আছে তার। সুযোগ পেলে আস্ত্রের মুখে পণবন্দী করেও পথচারীদের ফোন ও টাকা লুটে নেয়। এসব অপরাধে এ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে চারবার। তবে কিশোর হওয়ার সুবাদেই বারবার ছাড়া পেয়ে যায়। আরিফ ও তার সহযোগী কিশোর অপরাধী রাজ্জাক মূলত বাস বা জনবহুল স্থানে পকেট মারে। প্রতিপক্ষ তাদের থেকে দুর্বল হলে তখন পকেটমার থেকে তারা ছিনতাইকারীতে পরিণত হয় তাদের টার্গেট মূলত জনসাধারণের পকেটে থাকা মোবাইল সেট ও মানিব্যাগ। পকেটমার হিসেবে দুজনই খুব দক্ষ। পকেট কেটে এ পর্যন্ত এক থেকে দেড়শটি মোবাইল ছিনতাই করেছে। ছিনতাইকৃত মোবাইল বিক্রি করে গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেটের মফিজ ভাই, নজু ভাইসহ অনেকের কাছে। তবে বয়সে ছোট হওয়ার কারণে ন্যায্যমূল্য পায় না তারা। সে জানায়, নোকিয়া এন সিরিজের একটি মোবাইল আনতে পারলে তাদের মাত্র ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা দেয়া হয়। বেশি টাকা চাইলে বড় ভাইয়েরা পুলিশে দেয়ার ভয় দেখায়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে আরিফ চারবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। তবে বয়স কম থাকায় প্রতিবারই সে বেরিয়ে এসেছে। সে জানায়, আগে ছাড়া পেলেও এবার মনে হয় পাব না।
আরিফের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। অভাবের তাড়নার লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছয় বছর আগে এক প্রতিবেশীর সাথে ঢাকায় আসে। এখানে এসে পুরান ঢাকার একটি ওয়ার্কশপে ওয়েলিংয়ের কাজ শেখে। সেখানে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয় তার। এ জাহাঙ্গীর যে ছিনতাই ও পকেটমার শেখানোর ওস্তাদ তা সে জানত না। এক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জাহাঙ্গীর তাকে পকেটমার শেখায়। এরপর থেকে চলতে থাকে ছিনতাই ও পকেটমার। আরিফ ও রাজ্জাক মূলত একসাথে পকেট কাটার কাজ করে থাকে। এ কাজের জন্য তাদের কিছু সাঙ্কেতিক শব্দ রয়েছে। বুকপকেটকে বলে বুককান, পাঞ্জাবী বা প্যান্টের ঝুল পকেটকে নিচকান ও প্যান্টের পেছনের পকেটকে বলে থাকে পিচকান। বাস বা জনবহুল স্থানে পকেট কাটার জন্য তারা এক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে। এরপর ওই ব্যক্তির পিছু নেয়। সাধারণত রাজ্জাক ওই ব্যক্তির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের শরীর চুলকাতে থাকে। রাজ্জাকের হাত নাড়াচাড়ার এক ফাঁকে আরিফ ওই ব্যক্তির পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিয়ে যায় তার মূল্যবান জিনিসপত্র। হাত দিয়ে সহজভাবে কাজ সম্পন্ন না হলে সে ক্ষেত্রে ব্লেড ব্যবহার করা হয়। আর পকেট কাটার জন্য সব সময় জিলেট কোম্পানীর উন্নতমানের দামি ব্লেড ব্যবাহার করে থাকে বলে সে জনায়। দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৫-৪-২০০৮।
ঘ. দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া এক স্কুলছাত্রী শিমুকে ধর্ষণ করেছে দুর্র্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বিদ্যানগর গ্রামে এ ঘটনাটি ঘটে।
এলাকাবাসী জানায়, প্রতিবেশী লুৎফর রহমানের পুত্র হুমায়ুন (১৮) ও হযরত আলীর পুত্র শাকিল (১৫) দুজন মিলে ৮ বছর বয়সী দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী শিশুটিকে ধরে জোরপূর্বক একটি টমেটো ক্ষেতে নিয়ে যায়। সেখানে হুমায়ুন ও শাকিল পালাক্রমে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। এ সময় শিশুটির কান্না ও আর্তচিৎকার শুনে অশপাশের লোকজন ছুটে এসে শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে এবং উপজিলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে শিশুটির শারীরিক আবস্থায় আরো অবনতি হলে তাকে কিশোরগঞ্জের সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনার পরপর দুষ্কৃতিকারী হুমায়ুন ও শাকিল পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দৈনিক অপরাধকণ্ঠ, ০৫-০১-২০০৯।
বর্ণিত ঘটনাগুলো থেকে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধের মাত্রা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায।
কিশোর অপরাধ কী
মানবিক জীবনে কৈশোর কালটি নানা প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতার মাঝ দিয়ে পার হয়। স্কুল পেরুনো বয়সটাই হেলো উডু উডু চঞ্চল। বাধা না মানার বয়স। এ বয়সে বন্ধু খুঁজতে থাকে সে। পেয়েও যায়। বন্ধুকে ঘিরে যা সত্য না তাও ভাবতে থাকে। কখনও সে মধুর স্বপ্নে আনন্দে বিভোর থাকে। আবার কখনও বিভিন্ন জটিল সমস্যার কারণে ভিষণœতায় ভোগে। এ ক্রান্তিলগ্নে তার মাঝে এসে ভর করে অস্থিরতা, রোমান্টিসিজম, অ্যাডভারটারিজম ও হিরোইজম। এ সব চিন্তার মাঝে যেমন আছে ভালো লাগা তেমনই আছে নীরব পতনের পদধ্বনি।
সংক্ষেপে যে সমস্ত কাজ প্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় সে ধরনের প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী কাজ অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়। অন্য কথায়, অসদাচরণ অথবা অপরাধের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিচারালয়ে আনীত কিশোরকে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় যে, আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত কিশোররাই হচ্ছে কিশোর অপরাধী। কিন্তু আদালতের অপরাধ নিরূপণ পদ্ধতি ও রায় দেশ ও সমাজ ভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়। তাই বলা যেতে পারে যে, কোনো কিশোর অপরাধী কি না তা নির্ভর করে তার মাতাপিতা, প্রতিবেশী সমাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সর্বোপরি আদালতের বিচারকের মনোভাবের ওপর।
অপরাধ ও অপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত ১৯৫০ সালের আগস্টে লন্ডনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত যে সব আচরণ অসংগতিপূর্ণ বা আইনভঙ্গমূলক অর্থাৎ যা সমাজিকভাবে বাঞ্ছিত বা স্বীকৃত নয় তা সবই কিশোর অপরাধের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদিকে আমেরিকান চিল্ড্রেন ব্যুরো কিশোর অপরাধের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছে যে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধি বিরোধী সব কাজই কিশোর অপরাধের আওতাভুক্ত। উপরন্তু, সমাজ সদস্যদের অধিকারে আঘাত করে এবং কিশোরদের নিজের ও সমাজের কল্যাণের পথে হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়, কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত এমন যে কোনো মারাত্মক সমাজবিরোধী কাজও কিশোর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
অপরাধ বিজ্ঞানী cavan এবং ferdinand এর মতে সমাজ কতৃক আকাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শনে কিশোদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। পি ডব্লু টটাপপান কিশোর অপরাধীদের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন
ক. যার বৃত্তি আচরণ, পরিবেশ অথবা সংগীতদল তার নিজস্ব কল্যাণের পথে ক্ষতিকর।
খ. যে অবাধ্য, কিংবা যে তার মাতা-পিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়;
গ. ইচ্ছাকৃতভাবে যে স্কুল পালায় কিংবা সেখানকার নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং
ঘ. যে রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধি বহির্ভূত কাজ করে।( চলবে)