সুখ আসলে কী? যার অনেক আছে সে সুখী? বিষয়টিতে বিতর্কের উপাদান আছে!
যে অনেক টাকার মালিক, যার দামি গাড়ি-বাড়ি আছে, যিনি ক্ষমতা ও পদ-পদবিতে
ভারী কিংবা যিনি বড় চাকুরি করেন- বাহির থেকে চাকচিক্য দেখে তাকে সুখী ধরে
নেওয়া হয়। ঘটনা কি আসলেই তাই? এসবে সুখ নাও থাকতে পারে। সুখ হচ্ছে
তুষ্টিতে, সুখ আত্মিক প্রশান্তিতে। যে যতটুকুতে সন্তুষ্ট হতে পেরেছে তার সুখ
সেখান থেকে শুরু হয়। যার হৃদয়ে প্রশান্তি ভর করেছে সেই সুখী হয়েছে। কারো
অনেক আছে এবং আরও অনেক কিছুর জন্য ক্ষুধা ও লোভ আছে- সে সুখী হতে
পারে না; পারেনি অতীতের কোনকালে। কেননা হৃদয়ের প্রশান্তি বৈষয়িক সন্তুষ্টি
থেকে শুরু হয়। ভোগ এবং লোভের ক্ষুধা অসীম। সসীম ক্ষমতাসম্পন্ন জীব এই
অসীমতায় ডুবে গেলে স্রেফ অশান্তিতে হারিয়ে যায়। পেটের ক্ষুধা নিবারণীয়
হলেও মন ও চোখের ক্ষুধা কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। বরং অপূর্ণতার
অশান্তিতে জীবন পুড়তেই থাকে।
মানুষের কতখানি লাগে? জ্ঞানের জন্য পিপাসার্ত লোকের কাছে ধনের ক্ষুধার
খোঁজ পাবেন না। অর্থ-বিত্তের প্রতি যাদের সীমাহীন লোভ তাদের কাছে
সৌন্দর্যের মূল্য অতি সামান্যই। অশিক্ষিত মানুষের কাছে অর্থ, অহংকারী
মানুষের কাছে জ্ঞান এবং দুর্নীতিবাজদের মুখে নীতিকথা সমাজ ও রাষ্ট্রের
জন্য ভয়ানক হানিকারক। যারা সুখী তারা জানে কখন থামতে হবে। কেবল অর্থ
এবং ক্ষমতার মোহে জীবনকে ব্যস্ত রাখলে সে জীবন অপদার্থের। জীবনকে
উপভোগ্য করতে না পারলে সে জীবন ব্যর্থের। সুন্দর স্মৃতির জন্য পরিবারের
সাথে মধুর সময় ব্যয় করতে হবে, শখ পূরণ করতে শিশুদের মত মানসিকতা পুষতে
হবে কিংবা ঘুরতে গিয়ে বেঁচে থাকার অক্সিজেন খুঁজতে হবে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির
কঠিন হিসাব-নিকাশে জীবনটাকে জটিল না করে সাদামাটা স্বাচ্ছন্দ্যে সময়ের
পালে তাল খুঁজে নিতে হবে। জীবন আসলেই সুন্দর, যে জীবনের ছন্দ খুোজে
পেয়েছে।
একজন মানুষও তার নিজের অবস্থানে খারাপ নাই। তবে কেউ যখন তার সাথে, তার
অবস্থানের সাথে কিংবা তার প্রাপ্তির সাথে অন্যদের তুল্য করে নিজের অর্জন-
বিসর্জন পাল্লা করে তখন সে নিজেকে অসুখী অবস্থানে আবিস্কার করে। যখন
মানুষ তার ভাগ্য অস্বীকার করে, তার চেষ্টা আমলে নেয় না কিংবা তার যোগ্যতা
আড়াল করে না পাওয়ার প্রশ্ন তুলে স্রষ্টাকে দায়ী করে তখন তার মধ্যে আর
স্বস্তি-সুখের অনুভূতি থাকে না। জীবনের প্রত্যেকটি অংশ অন্যকারো সাথে
তুলনা করলে হতাশা আসবেই। আশার আলো কমবেই। কেননা যে আমার চেয়ে ভালো
আছে তার সাথেই কেবল নিজেকে তুলনা করি কিন্তু যিনি আমার চেয়েও অসহায়
তার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না- এটা মানব প্রবৃত্তির সবচেয়ে
কমন বৈশিষ্ট্য। লোভ এবং ক্ষোভ আমাদেরকে সুখী হতে বাঁধা দিচ্ছে। নিয়ত
হৃদয়ের প্রশান্তি হরণ করছে এবং অসুখীর দীর্ঘশ্বাসে জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য
খোওয়াতে বাধ্য করছে।
শারীরিক সুস্থতাই একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। মানসিক
প্রশান্তি না থাকলে আর কোন অর্জনই মানুষকে সুখী করতে পারে না। অথচ
আমরা শরীরের চামড়ার রঙ নিয়ে হতাশায় মুষড়ে পড়ি, চাকুরির উঁচু নিচু তুলনা করে
নিজেকে আফসোসে পোড়াই কিংবা অলীক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভে জীবনের রঙ
রস বিষিয়ে তুলি। অপ্রাপ্তির ক্ষোভে অহমিকা প্রকাশ করি, কথায় কথায়
বিষবাষ্প ছড়াই এবং অপ্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে মানুষকে অপ্রিয় করি। জীবন
থেকে অভিযোগ কমে এলে, রাগ-ক্ষোভ দমে গেলে এবং অবস্থানে তৃপ্তির রসদ
পেলে তবেই মানুষ হিসেবে নিজেকে সুখী দাবি করতে পারি। জীবনের আলটিমেট
গোল কী? এই যে এত প্রচেষ্টা, এত লড়াই-সংগ্রাম এবং ব্যস্ততা- এর সবকিছুর
চূড়ান্ত চাওয়ায় নিজেকে সুখী হিসেবে পাওয়া। অথচ এই সুখের পথে ভুলের
আয়োজনে যে যাত্রা তাতে অসুখ-অশান্তি কেবল বাড়িয়েই চলছি। অল্পে সন্তুষ্টি-
মানুষের অভিধানে এই শব্দ এবং বোধ সহজে মিলছে না।
আমরা শৈশবের সুখ খোওয়াচ্ছি বড় হওয়ার লোভে, ছাত্রজীবনের সুখ পোড়াচ্ছি
চাকুরির প্রলোভনে আর অবসর বিক্রি করছি ব্যস্ততার নির্মম রোলারের কাছে!
সৌন্দর্যের শোভা হারিয়ে ফেলছি কোন অশুভের ছায়া দেখবো বলে! মানুষ বড়
হওয়ার নামে ঝামেলা বাড়াচ্ছে এবং উন্নতির নামে মনের সুখ হারাচ্ছে। যে জীবন
তার অবস্থানে সন্তুষ্ট নয় সে একাই নষ্ট হচ্ছে- ব্যাপারটি তেমন নয় বরং তাকে
ঘিরে থাকা, তার ঘিরে রাখা আরও অনেক মানুষের শান্তি বিনষ্ট করছে। যে
দশতলায় সে আকাশ ছুঁতে চায়, যে গাছতলায় সে দশতলার দিকে দীর্ঘশ্বাসে চেয়ে
আছে! কে যে সুখে আছে তা বাহির দেখে বোঝা দায়। মানুষ নিজে সুখী হতে না চাইলে
প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিকতা জোড় করে কাউকে সুখের মালা পড়িয়ে দিতে পারে
না। প্রশ্ন হচ্ছে তবে সুখের মূলমন্ত্র কী? ওই যে সেই পুরানো কথা, অল্পে তুষ্ট
হও। হৃদয়ের প্রশান্তিতে নিজেকে জড়াও। খাই খাই আরও চাই- এমন স্বভাবের
একজনও ভালো নাই। জীবনের নামে যত অভিযোগ তা রোজ রোজের ধারাবাহিকতায়
কমাতে পারলে এবং প্রার্থনায় কল্যাণ কামনা করলে তবেই আত্মিক প্রশান্তি
নিশ্চিত হবে। বৈষয়িক অর্জন মানুষকে সুখের ঠিকানায় পৌঁছাতে অক্ষম যদি-না
মনের লোভ সসীমের বেড়ি না পরে!