আমরা যে অসুখী সেটার প্রধানতম কারণ ‘তুলনা’ এবং অন্যতম কারণ ‘আমার
এখনি লাগবে’ অর্থ্যাৎ অধৈর্য মনোভাব। আমার চাকুরি ভালো না ওরটা ভালো,
আমার লোকটা ভালো না তারটা ভালো। আামার এটা নাই ওটা নাই, তার এটা আছে
সেটা আছে- এই তুলনাগুলোই আমাদের মন খারাপের বড় কারণ। আমি অল্প কামাই
করি, সে বেশি কামাই করে- এই দুর্ভাবনায় রাত কাটে না। অমুক এতো ভালো
মানুষ, আমি তাঁর মতো ভালো মানুষ হই না কেন?- এমন তুলনা ভুলেও একবার করি
না! যেখানে আমরা স্বার্থ আছে, যেখানে আমার লাভ-ক্ষমতা আছে সেখানে
অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে ছটফট করি। এটা কেনো পেলাম না, সেটা কেনো
হলো না- এই দুশ্চিন্তায় রোজ বুড়ো হয়ে যাই।
আমার জীবন যে কেবল শুরু, সামনে এখনো অনেক পথ বাকি- অথচ এই পত্যূষেই
সবকিছু আমরা হোক- চেয়ে বসে আছি। পেতে আন্দোলন-অনশন করছি। লোভ-
ক্ষোভের দাহে পুড়ছি। সকালের যৌবনে বিকেলের বার্ধক্য দেখার জন্য হাপিত্যেশ
করি। আমাদেরও যে একটু ধৈর্য ধারণ দরকার, আরেকটু পরিশ্রম করা উচিত
কিংবা নিজেকে যোগ্য করার সাধনায় ভোগ ত্যাগ করা উচিত- সেটা ভাবি না।
আমলেও নেই না। ওর হয়েছে, আমরা হলো না কেনো- এজন্য কপালকে দোষারোপ
করি। পিতামাতাকে কৈফিয়তের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাই। দরিদ্রতাকে ভৎসনা
জানাই। এমনকি স্রষ্টার রীতি-পদ্ধতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ছাড় দেই না। যার
হয়েছে তার আত্মত্যাগ, পরিশ্রমের কথা ভাবি না। যে পেয়েছে তার ধৈর্য মাপি না।
কেবল আমার মনগড়া কথা বলেই জগৎটাকে আমার করতে চাই। অথচ কর্মফল
মিথ্যা নয়। আমাদের তো কর্মই নাই! ফল আসবে কোথা থেকে? যতসব অকাজ-
কুকাজ করে বেড়াই। সেসবের ফলও হাতেনাতে পাই। তাতে জীবনে দুঃখ জমে আরও।
যে মানুষটি আমার ভাগ্য জুটেছে তার খুঁত খুঁজতে লোক ভাড়া করি। নিন্দা করতে
আড্ডা জমাই। জীবনের সাথে তুলনা করি সিনেমায়। যা দেখি তা অলীক স্বপ্ন,
ভাবনায় অলীক কল্পনা। এসব কিন্তু মিথ্যা গল্প না। নায়ক/নায়িকার চলা-বলা,
ছলা-কলা ভালো লাগে, পথের মানুষের ব্যবহার ভালো লাগে, কারো হাসি ভালো লাগে
কিংবা কারো দেখেছি বাহিরের রূপ- তাতে মজে যাই। আমিও যে সাজাতে পারতাম
তারে সেটা একবারও ভাবনায় আনিনি। ভুল ধরতে ব্যস্ত থেকেছি, শরীরে গন্ধ
পেয়েছি কিংবা পাশে বসতে পেয়েছি লজ্জা। যে আমাকে পথ দেখিয়েছে, শিখিয়েছে
স্বপ্ন দেখতে সে পরিণত হয়েছে শত্রুতে। ভালোবাসা মেপেছি রূপের কৌটায় কিংবা
পকেটের পয়সায়! অন্যের চাকুরিকে খুব আকর্ষণীয় ভাবি। মনে হয় স্বর্গের সব
সুখ ওপারে। সমগ্রেডে কিংবা নিম্নপদে চাকুরি করে কেউ কেউ গাড়ি বাড়ি করে
ফেলেছে, অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে কিংবা আকর্ষণীয় জীবনযাপন করছে দেখে
হিংসায় পেরেশান। অথচ তার অসততা, ঘুষের কারবার ভাবিনি! তার ধ্বংস আঁকতে
পারতাম- আঁকিনি। ভেবেছি সম্পদেই সুখ! এই অসুখে আমায় পেলে দুঃখ আছে।
পরের সাথে ঘরের তুলনার মানিসকতা আমাদের দুঃখী করেছে। অন্যের আয়নার
সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখায় আমাদের সুখ হারিয়েছে। আমি তো- আমি, অন্য
কেহ নয়। সে তো সে- আমি নই। কারো ভালো দেখে ভালো হওয়ার বা ভালো করার
প্রেষণা আমাদের মাঝে খুব অল্পই। অন্যের খারাপ রূপ দেখে সেখানে নিজেকেও
কল্পনা করি কেননা পয়সার লোভ আমাদেরকেও পশু করেছে। বিবেকের সুবিচার
লোপ পেয়েছে। দু’টাকা সুদ-ঘুষের জন্য দুনিয়ার সব রীতি-নীতিতেও লাথি দিতে
পারি। চোখ উল্টে ফেলতে পারি পলকে কিংবা মুহূর্তের মধ্যে সত্যকে ঢেকে
ফেলতে পারি মিথ্যায়। অভিনয়ে আমি কম পাকা নই! মোটকথা, সমাজটাকে
এমনভাবে নষ্ট করা হয়েছে যেখানে আবর্জনা চকচকে মোড়কাবদ্ধ করে দিলেও
আমরা হাত পেতে গ্রহন করি- সেটা জেনেও। অল্প টাকায় বিক্রি করে দেই ঈমান।
ধর্মের যেটুকু তা আমার স্বার্থের প্রয়োজনে সুযোগ মতো মুখোশ হিসেবে নিয়েছি।
বাকিসব ছলাকলা!
নিজেকে ভালো মানুষে পরিণত করার জন্য অন্যের ভালো দেখে সেখানে পৌঁছাতে
আমার জেদ হোক। কিন্তু কারো সাথে নিজের তুলনা করে আমার সুখ-শান্তি, হাসি-
আনন্দ বিলীন করার কোন মানেই হয় না। এসব নিরর্থক। অন্যের সাথে নিজেকে
গড়পরতায় যতোটা তুলনা করবো নিজের অবস্থান তত ঠুনকো হবে। ভাগ্যের নামে
যত অভিযোগ তুলবো আমার বঞ্চিতের ইতিহাস তত লম্বা হবে। নিজেকে যত
অপমান করবো তত বদনাম ছড়াবে।খোদাকে যতবার দায়ী করবো তত বারাকাহ
কমে যাবে। অল্পে তুষ্ট থাকার, কারো সাথে অহেতুক তুলনা না করার অভ্যাসকে
পোক্ত করতে হবে। যাকিছু নিজের তা পরিশুদ্ধভাবে ব্যবহার করতে শিখতে হবে।
অন্যের অনেককিছু আছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলে কোন লাভ নাই; আফসোস
ব্যতীত। তুলনা কমিয়ে দিন এবং সবর বাড়িয়ে নিন- ভালো থাকা সহজ হবে।
আয়ুস্কাল আপনাকে বঞ্চিত রেখে কবরে নেবে না- পূর্ণতম বিশ্বাস রাখুন।
হিসাবের একাংশ এপারে, বাকি সর্বাংশ ওপারে। তিনি ন্যায়ের, ন্যায়বিচারের
ধারক-বাহক।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com