বেলাল আজাদ, কক্সবাজার:
কক্সবাজারের উখিয়ায় বয়োঃবৃদ্ধ ও অসুস্থ মা-বাবা কে নিজের পুত্র কতৃক নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন, বঞ্চিত ও নিঃস্ব এমনকি বর্বর ভাবে মারধর করা অত্যাচারী অবাধ্য, কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল, ভুক্তভোগী নিজের নির্যাতিত পিতার দায়েরকৃত মামলায় কারাগারে গেছে। চাঞ্চল্যকর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা উখিয়া থানার এস.আই (নিরস্ত্র) কার্তিক পাল এর নেতৃত্বে উখিয়া থানার এক পুলিশ টেকনাফ থানা পুলিশের সহায়তায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলার দূর্গম এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ২০ ডিসেম্বর আদালতে সোপর্দ করলে, আদালত মা-বাবা কে নির্যাতনকারী কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল কে কারাগারে পাঠায়। ভুক্তভোগী পিতা উপেন্দ্র শীল (৭০) উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের রুমখাঁপালং বউ বাজার (নাপিতপাড়া) এলাকার মৃত কামিনী শীলের পুত্র। অভিযুক্ত অবাধ্য ও অত্যাচারী ছেলে তপন শীল (৩৮) ও তার স্ত্রী পূজা শীল (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ে মিলে দীর্ঘ দিন ধরে বয়োঃবৃদ্ধ পিতা তপন শীল (৭০) ও মাতা বাসনা শীল (৬০) কে নির্মম ভাবে নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, বঞ্চিত, নিঃস্ব এমনকি প্রহার পর্যন্ত করে আসছিল। ছেলের অত্যাচারে ও মারধরে অতিষ্ট ও গুরুত্বর আহত পিতা উপেন্দ্র শীল বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা যায়, ভূক্তভোগী বয়োঃবৃদ্ধ পিতা উপেন্দ্র শীল ও মাতা বাসনা শীল অনেক টাকা ধার-দেনা ও ব্যয় করে অভিযুক্ত পূত্র তপন শীল কে বিবাহ করায় এবং পরবর্তীতে কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাঠায়। কিন্তু কুলাঙ্গার পূত্র তপন শীল বিদেশে পাড়ি দিয়েই পাল্টে যায়, পিতা-মাতার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং মা-বাবার ভরণ-পোষণ বা চিকিৎসা খরচ দেওয়া দূরে থাক, তাকে বিদেশ পাঠানোর জন্য করা ধার-দেনা পরিশোধ করা থেকেও বিরত থাকে। ফলে ধারদেনায় জর্জরিত অসুস্থ ও বয়োঃবৃদ্ধ পিতা-মাতা চরম দুঃখ-দূর্দশায় ও দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং সীমাহীন অভাব-অনটনে ও পাওনাদারদের জ্বালাতনে মানবেতর দিনাতিপাত করতে থাকেন। অবাধ্য কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল কয়েক বছর প্রবাসে থেকে দেশে ফিরে আসলে, ভুক্তভোগী অসহায় পিতা-মাতা তাদের ধার-দেনা শোধ ও ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা ব্যয় করার কথা ছেলে কে বললে, অভিযুক্ত পূত্র তপন শীল তাদের কথা অগ্রাহ্য করে উল্টো গালিগালাজ ও হাঁকাবকা করে মা-বাবা সহ স্বপরিবারে বসবাসরত বসতভিটার (বন বিভাগের দখলীয়) জমির দখল-স্বত্ব তার নামে লিখে দিতে চাপ সৃষ্টি করে। কুলাঙ্গার পুত্রের ‘বসত ভিটের জমি লিখে দেওয়ার’ অন্যায় প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায়, অভিযুক্ত পুত্র তপন শীল ও তার স্ত্রী পূজা শীল মিলে বয়োঃবৃদ্ধ পিতা-মাতা কে শারীরিক ও মানসিক নির্মম নির্যাতন করতে থাকলে, ভুক্তভোগীরা অনেকের কাছে সালিশ-বিচার দিলেও, একাধিকবার এলাকায় সালিশ-বৈঠক হলেও পূত্র ও পুত্রবধুর নির্যাতন থেকে রেহাই মিলেনি।
সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর দুপুরে অবাধ্য কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল ও পুত্রবধু পূজা শীল (স্বামী-স্ত্রী) মিলে, বয়োঃবৃদ্ধ মা-বাবা কে লাঠিসোটা দিয়ে নিষ্টুর ভাবে মারধরে রক্তাক্ত জখম করে। এলাকার লোক আহত অবস্থায় বয়োঃবৃদ্ধ বাবা উপেন্দ্র শীল ও মা বাসনা শীল কে উদ্ধার করে উখিয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেে ভর্তি করেন। চিকিৎসায় সামান্য সুস্থ হওয়ার পরে ভুক্তভোগী বয়োঃবৃদ্ধ পিতা উপেন্দ্র শীল নিরুপমায় হয়ে অত্যাচারী পুত্র ও পুত্রবধুর শাস্তি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন।
গত ১৫ নভেম্বর ভুক্তভোগী বয়োঃবৃদ্ধ পিতা তপন শীল বাদী হয়ে কক্সবাজারের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় (উখিয়া) আমলী আদালতে মামলা (সি.আর. নং-৩৪৭/২০২১, ধারা: ১১৪/৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩০৭/৫০৬(২)/৩৪ দন্ডবিধি) দায়ের করলে, আদালতের বিজ্ঞ বিচারক জনাব হেলাল উদ্দীন মামলাটি সরাসরি আমলে নিয়ে ‘নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু ও তদন্ত সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার’ জন্য অফিসার ইনচার্জ উখিয়া থানাকে আদেশ দেন। আদালতের আদেশ মতে ওসি ও ওসি (তদন্ত) ‘উখিয়া থানার মামলা নং-৩৭, তাং-০৭/১২/২০২১ইং, জি.আর. নং-১০৫২/২০২১’ রুজু করেন এবং মামলাটির তদন্তের জন্য উখিয়া থানার এস.আই (নিরস্ত্র) কার্তিক পাল কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা (আই.ও) মামলা তদন্তের পাশাপাশি আসামী গ্রেফতারেও তৎপর হয়ে উঠেন। গত ২০ ডিসেম্বর অভিযুক্ত কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল কে টেকনাফ থানা পুলিশের সহায়তায় টেকনাফ উপজেলার হৃীলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করলে, আদালত তপন শীল কে কারাগারে পাঠায়।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এস.আই (নিরস্ত্র) কার্তিক পাল জানান, অবাধ্য পুত্র ও পুত্রবধু কতৃক বয়োঃবৃদ্ধ, অসুস্থ ও অসহায় পিতা-মাতা কে নির্মম ভাবে নির্যাতন-মারধর করার মত জঘন্যতম ঘটনায় দায়ের হওয়া চাঞ্চল্যকর এই মামলার যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম এবং পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা অপর আসামী পূজা শীল কেও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
এলাকার জনপ্রতিনিধি হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের বারবার নির্বাচিত ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার স্বপন শর্মা রনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, আলোচিত পিতা-পুত্র দীর্ঘ দিনের বিরোধের বিষয়টি স্থানীয় ভাবে আপোষ-মিমাংসা ও সমাধান করার অনেক চেষ্টা করা হলেও, কোন সুরাহা না হওয়ায় তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, সমাজে এমন মা-বাবা, পুত্র বা পুত্রবধু, ভাই-ভাইবোন অর্থাৎ পরম আপনজন, একই পরিবারের ও একই রক্তের-বন্ধনের স্বজনদের মধ্যে হানাহানি, বিরোধ, নিষ্ঠুরতা কাম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞ আদালত যথাযথ ন্যায়গত সুরাহা দিতে পারে বলে আমার মনে হয়। অন্য দিকে সন্তান যত অপরাধী বা অত্যাচারী হোক, ভুক্তভোগী মা-বাবার কাছেও কোন সন্তান ফেলনা, পর বা বোঝা কখনোই নয়।
মামলাটির বাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী এড. মোঃ ছানাউল্লাহ বাপ্পী বলেন, নিজের ছেলের হাতে বৃদ্ধ, অসুস্থ, অসহায় ও নিঃস্ব বাবা-মা কে এত নির্মম ভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিত ও প্রহৃত হওয়ার মত জঘন্য ঘটনা এক বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাল যাপনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! অতীতের অন্ধকার কোন যুগেও এমন ঘটনা বিরল বলা চলে। এতে বুঝা যায়, দিন দিন কিছু কিছু মানুষ মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার বদলে উল্টো নির্বোধ, নির্মম ও অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। মামলাটি দায়ের কালে ‘ছেলের হাতে মা-বাবা কে নির্যাতিত-নিপীড়িত, বঞ্চিত ও নির্মম মারধরে আহত করার করুণ-হৃদয় বিদারক বর্ণনা শুনে স্বয়ং আদালত ও তথায় উপস্থিত প্রত্যেকেই স্তব্ধ হয়ে যান এবং মাননীয় বিচারক মহোদয় তৎক্ষনাৎ মামলাটি সরাসরি আমলে নেন। নিজের পিতা-মাতা কে অত্যাচারী, মারধরকারী অভিযুক্ত কুলাঙ্গার পুত্র তপন শীল ও পুত্রবধু পূজা শীল’র কঠোর, দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
Post Views: 231
Like this:
Like Loading...
Related