শতাব্দীর গোড়ার দিকে মানুষের অন্নের সংকট, বস্ত্রের মলিনতা, বাসস্থানের
সংকীর্ণতা ছিল বটে কিন্তু প্রবলভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ উপস্থিত ছিল।
নীতির প্রবাল্য শব্দটি একারনে ব্যবহার করেছি যে, বর্তমানের সাথে সে সময়ের
তুলনা করলে বর্তমানকে নিয়ে হতাশ হতে হয়। অর্থ-বিত্তে মানুষের চারপাশ
চাকচিক্যময় হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সহ্য করে মানুষ ভোগ-বিলাসে অভ্যস্থ
থাকছে অথচ চরম দরিদ্রতা নেমে এসেছে নৈতিকতা চর্চার মন ও মননে।
দিনে দিনে মানুষ হারিয়ে ফেলছে সত্যতা, সাধুতা এবং নৈতিকতা। অর্থ কীভাবে
উপার্জিত হচ্ছে, কোন পথে হাঁটছে সেসবের বিবেচনাবোধ মনুষ্যত্বের অভিধান
থেকে মুছে যাচ্ছে। নীতিপথ বিবর্জিত প্রবল ভোগবাদী মানুসিকতায় সমাজ অসুস্থ
হয়ে যাচ্ছে। স্বার্থবাদের যুগটা বোধহয় প্রকটভাবেই প্রতিভাত হচ্ছে।
কৃষক থেকে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক থেকে সুশীল-কেউই এই দুষ্টত্বের বেড়াজাল
থেকে মুক্ত হতে পারছে না। কেউ চেয়ে ঘুষ খাচ্ছে আবার কেউ বাধ্য হয়ে
ভাগের টাকা ব্যাগে ভরছে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্ষতিকর
রাসয়নিক ব্যবহার, অবাধে দ্রব্য মজুদ, পরিবহনে স্বেচ্ছাচার, শিক্ষকের ক্লাসরূমে
ফাঁকি কিংবা কর্তা কর্তৃক ফাইল আটকে রাখা কিংবা অন্যের দূর্বলতাকে জিম্মি
করে সর্বনাশ ঘটানোর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নৈতিকতার দূর্দশার যুগে ছিঁচকে
পকেটমার এর অটো-রিকশা চালকদের দ্বিগুণ ভাড়া আদায়কে কেন জানি আর
অপরাধের তকমা দিতেই বিবেক বাধা দেয়। কতোকিছু ঘটার কালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
কিছুর শাস্তি হিসেবে কেবল ঘৃণাই করা যায়।
ছোটবেলায় যে প্রজন্ম বাবা-মায়ের পকেট-আঁচল থেকে দু’-পাঁচটাকা না বলে
নেয়া অপরাধ মনে করতো সেই প্রজন্মই উৎপাদনে এসে ব্যবসায়ী হিসেবে
ব্যবসার নীতিমালা, চিকিৎসক হিসেবে সেবার মানসিকতা, চাকুরিজীবী হিসেবে
রাষ্ট্রের ঋণ আর মনে রাখছে না। অতিরিক্ত লাভের আশায় বাজারে কৃত্রিম
সংকট তৈরি করা, নীতিমালার তোয়াক্কা না করে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, নকল করে
পাশ করার প্রবণতা, শিক্ষার্থীকে অন্যায় সুযোগ দেয়া, রাজনীতির অপচর্চা-এসব
আমাদের নিত্যাকার ব্যাধি।
ক্লাসরুমে যে শুদ্ধাচার শেখানো হচ্ছে সেটা ব্যবহারিক জীবনে কোন এক অশুভ
ইঙ্গিতে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবার থেকে ন্যায়-নীতির চর্চা প্রায় হারিয়ে গেছে।
ভালো এবং মন্দের পার্থক্য যেটুকু শেখা ও শেখানো হচ্ছে তা কর্মক্ষেত্রের অসৎ
প্রতিযোগিতা, মুনাফা অর্জনের দৌরাত্ম্য এবং যেকোনভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার
অসুস্থ মানসিকতায় টিকছে না। শ্রম না দিয়ে বিত্তশালী হওয়া, না পড়ে পরীক্ষায়
ভালো ফলাফল অর্জন, যেকোন কাজে সুপারিশ-এসব আসলে মেরুদন্ড মুষড়ে
দেওয়ার ভূমিকা নিচ্ছে। কেবল নিজে বেঁচে যাওয়ার জন্য মানুষ বেচে দিয়েছে
আত্মসম্মান। কোথাও কোন অন্যায় হলে একান্ত বাধ্য না হলে সেসবের মুখোমুখি
কেউ হতে চায় না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম’-নীতিই যেন সুনীতির পথ
নিচ্ছে! যা আপাতদৃষ্টিতে নিরুদ্রুপ মনে হলেও এটা সামষ্টিভাবে সমাজকে ভালো
বার্তা দেয় না।
চারপাশে আলোকিত মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে হৃাস পাচ্ছে। যারা সমাজ-
সভ্যতাকে তাদের কর্ম দিয়ে আলোকিত করতে পারেন-এমন মানুষ দিনে দিনে
বইয়ের পৃষ্ঠা ও অগ্রজদের গল্পে স্থান পাচ্ছে। কেবল যান্ত্রিকতা এবং নিজে রক্ষা
পাওয়ার প্রবনতা আসলে কাউকেই বাঁচাতে পারে না। যে সমাজে দুর্নীতি-
অনাচার মাথাচার দিয়ে ওঠে সেই সমাজে মানবতা-সহমর্মিতা আর টিকে থাকতে
পারে না। তখন সমাজের মানুষগুলোর একাংশ পশুত্বের চরিত্র চর্চায় মেতে ওঠে
এবং বাকি অংশ সেই পাশবিকতার বলি হয়।
আইন এবং শাস্তির মাধ্যমে কিছু সমস্যার প্রতিকার ঘটানো সম্ভব বটে তবে যে
নৈতিকতার বাস মন ও মননে সেখানে জবরদস্তিতে খুব বেশি উন্নতি ঘটানো
সম্ভব নয়। পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজকেই মানুষকে শোধনের দায়িত্ব নিতে
হবে। রাষ্ট্রকেও এ ব্যাপারে ইস্পাত কঠিত দৃঢ়তায় অবস্থান করতে হবে। এই
দেশের এই সমাজের বহু ধরনের সম্পদ আছে বটে কিন্তু আলোকিত মানুষের
দীণতা হৃাসে মহা-পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। প্রত্যেক ফাগুনে নীতিবান
মানুষের সংখ্যা দ্বিগুন হোক-এই প্রত্যাশায়।
রাজু আহমেদ। কলামিস্ট।
Raju69alive@gmail.com