পারিবারিক ভাবে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও মা আমার বউকে পছন্দ করেন না। কারণ একটাই, আমার শ্বশুর নগদ টাকার সাথে একপাটি সোনার চেইন দেননি মেয়েকে। মায়ের এক কথা, আমরা বলিনি তাই বলে কি মেয়েকে সোনার একটা চেইন দিবে না?
বিয়ের তারিখ ঠিক করার আগেই আমার পরিবার দু’লাখ টাকা দাবী করেছিলো সামিয়ার পরিবারের কাছে। ছেলে মাস্টার্স পাস, বেসরকারি এক কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করে। এমন ছেলের জন্য মাত্র দু’লাখ টাকা চেয়েছে এটাতো খুবই সামান্য আর এই সামান্য টাকার সাথে একটা চেইন কেন দিবে না?
সোনা বলতে বিয়েতে আমাকে তারা একটা আংটি দিয়েছে। সেটাই নাকি রীতি। আমি বাবা মা’কে অনেক বলেছি টাকা পয়সা নিয়ে আমি বিয়ে করবো না। মা বলেন টাকা না নিলে বউয়ের শাড়ি, গয়না এসবের টাকা কোথায় পাবি? আমাদের কি ক্যাশ কিছু আছে নাকি ঘরে! আমিও জানি ঘরে ক্যাশ বা ব্যাংকে জমা তেমন কিছুই নেই৷ চাকরি করি দু’বছর হলো৷ বাবার চাকরি গেছে একবছর আগে। আর এ দুবছরে যে টাকা ইনকাম করেছি তা দিয়ে স্বচ্ছলভাবে সংসার চালিয়ে মাসে দু,তিন হাজার করে জমানো হয়েছে মায়ের নামে।সেই টাকা আমার ছোট বোনের ভবিষ্যত ভেবেই জমানো। এতে আমার বিন্দু পরিমাণ আপত্তি নেই। আমি নিজেও চেষ্টা করছি আলাদাভাবে যতটুকু সম্ভব একমাত্র বোনের জন্য জমিয়ে রাখতে। কিন্তু মায়ের আচরণ দিনকে দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। সামিয়া চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে বিয়ের পর মা যেদিন প্রথম তাকে চা খারাপ হয়েছে বলে ধমকে দিলো, সেদিন সে মায়ের বিপরীতে টু শব্দটিও করেনি। দ্বিতীয়বার মা তাকে কথা শোনালো তার নাকি রান্না ভালো না তাই আমার বোন মিলি ঠিকমতো খাবার খায় না। সেদিনও সে মায়ের সামনে চুপ ছিলো। তবে আমি অফিস থেকে ফেরার পর তার ভার করা মুখটা দেখে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাসায় কি কিছু হয়েছে?’ মা তখনই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো এই বলে, ‘স্বামী বাড়িতে পাও দিতে না দিতেই শ্বাশুড়ি, ননদের নামে লাগাইছে। এই মাইয়া বেশিদিন সংসার করবো না আমগো লগে।’ আমি আর কিছু না জানতে চেয়ে আবার ঘরে গেলাম। সামিয়াকে অনেক প্রশ্ন করার পরও সে জবাব দিলো না এই বিষয়ে। তারপর কাটলো আরও এক সপ্তাহ। বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরতেই দেখি সামিয়ার বাবা মানে আমার শ্বশুর এলো। আমি বেশ অবাকই হলাম সন্ধ্যেবেলায় উনার আগমনে। তবে মায়ের মুখ লক্ষ্য করে বুঝলাম আমার মা ভীষণ বিরক্ত এই সন্ধ্যায় আত্মীয়ের উপস্থিতিতে। সামিয়া তার বাবাকে ডাকলো আমাদের শোবার ঘরে যেতে। আমি আরও অবাক হলাম এই দেখে। শ্বশুরমশাই এসেছেন বসার ঘরে বসিয়ে আগে কিছুটা আপ্যায়ন না করেই সামিয়া ঘরে কেন নিয়ে গেল! মেয়ের সাথে বাবার একাকী বলার মত অনেক কথাই থাকতে পারে তাই বলে আমার মা,বাবার সাথে ভালো মন্দ দুটো কথা না বলেই ভেতরে যাবেন! আমিও অফিস থেকে এসেছি ফ্রেশ হওয়া দরকার ভেবে ঘরে গেলাম তখনই দেখলাম সামিয়া আলমারী থেকে তার দু’তিনটে পুরনো সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে তার বড় হাত ব্যাগটায় ঢোকাচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই আমার শ্বশুর বললেন, ‘মাহবুব তুমি কি বলো?’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কি করেই বা বলি আমি তো জানিই না কিছু। সামিয়া মুখ খুলল, ‘আব্বা, উনি কিছুই জানেন না। মা আমাকে দুপুরে বলছেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে এখন আসতে বলছি যেন উনিও থাকেন যাওয়ার সময় জানিয়ে যাবো।’
সে রাতে সামিয়া চলে গেল তার বাবার সাথে। আমি শুধু বলেছি, ‘বাবা যেহেতু এসেছেন তুমি না হয় যাও আজ। কাল বৃহস্পতিবার পরশু শুক্রবার আমার ছুটি আছে। আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসবো।’ এরপর সামিয়া আর কোন কথা বলেনি।সামিয়ারা চলে গেলে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
‘ধলা দেইখা বউ আনছো তা নিয়াই থাকতে হইবো৷কাম কাইজ তো আর রুপ যৌবনেভরা মাইনষের লাইগ্যা না’ মায়ের জবাব।
বুঝলাম সামিয়া হয়তো মায়ের কথামত কোন একটা কাজ করতে পারেনি তাই কথা শুনিয়েছেন৷ আমি রাতে সামিয়াকে ফোন করলে সে বলল, ‘আমার বাবার পক্ষে হয়তো স্বর্ণের চেইন দেওয়া সম্ভব হবে না। আপনি যদি বলেন তবে আমি না হয় ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করতে বলি বাবাকে। আমার বাবার সাধ্যের মধ্যে সবটা দিয়ে আমায় বিয়ে দিয়েছেন৷ এমনকি কিছু টাকা ঋণও করেছেন৷ তাই আমি বাবাকে কিছুতেই চেইনের কথা বলতে পারবো না।’ সামিয়া তার কথা শেষ করে আরও কিছু যেন বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু বলল না। আমি আবারও বুঝলাম মা শুধু কোন কাজের জন্য নয় হয়তো আবার চেইন নিয়েও কিছু বলেছে। রাতের খাবার খেতে বসেই মাকে বললাম, ‘আমি ভাবছি সামিয়াকে নিয়ে আলাদা থাকবো।’
মা ভাতের চামচটা ভাতের বোলে রেখে আমার দিকে তাকালেন, ‘ এই কয়মাসেই বউ তোরে জাদু করলো! সারাজীবন কোলেপিঠে কইরা মানুষ করলাম আর দুই দিনেই সব গুলাইয়া খাওয়াইছে বউয়ে৷ আমারই কপাল! সুন্দর দেইখা বউ আনছি পোলারে জাদু করনের লাইগ্যা। আমার পোলা আমার নাই ওই হারামজাদী মাগী আইতেই সংসার আলেদা করতে চাইতাছে।’
মা মুখ খারাপ করছো কেন? সামিয়া কিছুই বলেনি। বিয়ে করেছি চার মাস হলো এরই মধ্যে কয়েকদফা তুমি তাকে বাড়ি থেকে যেতে বলেছো। তুমি তাকে কথায় কথায় সোনার গয়নার জন্য অপমান করছো এমনকি তোমার প্রশ্রয়ে আজকাল মিলিও তাকে কথা শোনায়। সে পরের মেয়ে বিয়ে করে এ বাড়িতে এসেছে আজীবনের জন্য । তোমরা যদি তাকে এই চার মাসেই এতোটা অপমান, অপদস্থ করো বাকিটা জীবন থাকবে কি করে! মা তুমিও অন্য বাড়ির মেয়ে ছিলে একসময়৷ এ বাড়িতে তুমি নতুন ছিলে তখন কি তোমাকেও কেউ এভাবে কথা শোনাতো?’ আমি থামতেই মা বললেন, ‘হ শোনাইছে কথা তোর দাদী। দিনরাত আমারে অপমান করছে শিল পাটায় মশলা বাটার মত কইরা দিনরাত পিষছে মুখের কথায়। কই তোর বাপ তো একটাদিনও তার মায়ের লগে বউ নিয়া তর্ক করে নাই তুই করতাছিস ক্যান?’ বলতে বলতে মা কেঁদে দিলেন। বুঝলাম মায়ের মনে আক্ষেপ তাঁর নিজের শ্বাশুড়িকে নিয়ে আর এখন সেই আক্ষেপ,ক্ষোভ মিটিয়ে নিতে চাইছেন তার ছেলের বউয়ের ওপর। সময়ের সাথে সব বদলে গেলেও মায়ের মনের ক্ষোভ তার শ্বাশুড়ি হওয়ার ক্ষমতাকে নেতিবাচক এক মনোধারা দিয়েছে। কিন্তু এরও তো একটা সমাধান আছে৷ আমি মাকে আবারও বোঝাতে চেষ্টা করলাম এটা ভুল। তার সাথে যা হয়েছে তাই অন্যজনের সাথে করাটাই যুক্তিযুক্ত কাজ নয়। পরিবর্তন করতে চাইলাম মায়ের আদিম সেই ধারণা। কিন্তু মা বুঝলেন না বরং ঘোষণা দিলেন এ বাড়িতে সামিয়া আর কখনোই পা রাখতে পারবে না। আমি শেষ পর্যন্ত বাবাকে বোঝাতে চাইলাম এমন করলে একসাথে থাকা কষ্টকর হবে হয়তো এক সময় এই কষ্ট থেকে সম্পর্কে তিক্ততা আসবে, চিড় ধরবে। কিন্তু বাবাও বুঝলেন না তিনি এখন মায়ের সিদ্ধান্তকেই গ্রহণ করলেন। সত্যিই আর সামিয়া ফিরতে পারলো না আমাদের বাড়ি এমনকি আলাদা করে সংসার করাও হলো না। আমি একদফা,দু দফা চেঁচামেচি করে আবার চুপ হয়ে যেতাম। বাবা মাকে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না সামিয়াকে বোঝাতে পারছিলাম না আমার অবস্থা । সামিয়া নিজেই একদিন ফোন দিয়ে বলল, ‘আপনি তো আর আসতে পারবেন না কখনোই আমার কাছে অথবা আমিও যেতে পারবো না ও বাড়ি৷ তাই,,,’ একটু থামলো সামিয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ভেতরই একটা শক্ত প্রলেপ লেপে বলল, ‘ ডিভোর্স করে ফেললেই ভালো হয় আমাদের জন্য।’ আমি থমকে গেলাম সামিয়ার কথায়। মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া হতেই সে ডিভোর্স চাইছে! স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কি এতোটাই ঠুনকো?আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম সামিয়াকে সে বুঝলো না। বিয়ের মাত্র চার মাসেই আমার আর সামিয়ার মধ্যে আত্মিক মিত্রতা এতোটা বেশি হয়তো গড়ে ওঠেনি যার জন্য সামিয়া আমার ওপর ভরসা রাখবে৷ কিন্তু তাই বলে চাইলেই ছেড়ে যাওয়া যায় এতখানি দূর্বলও তো নয়! আমি আঘাত পেলাম মনে মুখে প্রকাশ করলাম না। বাড়িতে মায়ের সাথে আরো একদফা কথা বললাম মা তেমন কোন জবাব দিলেন না। মনে হলো এমনটাই যেন তিনি চাইছিলেন৷ মুখে তাঁর এক লুকানো তৃপ্তির ছায়া। মা আর সামিয়ার মধ্যে আমি পিষে গেলাম মশলার মত। মাস খানেক পরেই সামিয়া ডিভোর্স এগ্রিমেন্ট এর জন্য কোর্টে যেতে বলল। বাবা দু একবার বলেছিলেন বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মা তাতে ভ্রুক্ষেপহীন। সামিয়াকে আমি নিজে কয়েকবার দেখা করে বললাম, ‘ সংসার ভাঙার দরকার নেই আমরা আলাদা বাসায় থাকবো।’ সে কথা শুনে সামিয়া বলল আমি নাকি মেরুদণ্ডহীন তাই আমার সাথে সংসার করা মানে সারাজীবন নিজেকে জ্বালিয়ে মারা। আজ মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকতে চাইছি কাল নাকি তাকে ছাড়তে চাইবো। তাই এখনি আলাদা হওয়া উচিত এখনও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি৷ আমি আবারও আঘাত পেলাম সামিয়ার কথায়। প্রেমের বিয়ে না হলেও বিয়ের পর ভালোবেসেছিলাম বউকে। আগলে রাখতে চেয়েছি আমরণ, কিন্তু আমি ব্যর্থ।ব্যর্থতা আমার জীবনের মজবুত এক অংশ। চলে গেছে সামিয়া আমিও চলে এসেছি মা বাবাকে ছেড়ে। দূরে থাকি, একা থাকি শুধু সময়মত বাবা – মা বোনের খরচ পাঠাই আর লুকিয়ে চুরিয়ে সামিয়ার সংসার দেখি। আমি যে বাসায় থাকি তার ঠিক পেছনের বাড়িতেই সামিয়ার নতুন সংসার। স্বামী, শ্বাশুড়ি আর এক ননদ নিয়ে তার সংসার। বেশ আছে সে তার নতুন ঘরে আমার মত ব্যর্থ নয় তার নতুন স্বামী। আমি পারিনি সংসারের সামান্য একটু ঝামেলা মিটিয়ে মা বউকে একসাথে রাখতে। আমার মত ব্যর্থপুরুষ কি আর কোথাও আছে! দিন শেষে তারা সবাই ভালো আছে আমিও আছি আমার ব্যর্থতা নিয়ে। নিজের ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে সুখেই আছি ।
সমাপ্ত
ব্যর্থতা
রূবাইবা মেহউইশ