মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণের সাথে সাথে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’ কে প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। তফসিলি সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক নেতার ১২১ তম জন্মবার্ষিকী চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে অতল শ্রদ্ধা। আজও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখযোগ্য। বরিশাল থেকে করাচির ক্ষমতার অলিন্দ হয়ে বনগাঁ, যোগেন মন্ডলের জীবন-সংগ্রাম প্রান্তজনদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক মাইলফলক। সমাজের অনগ্রসর ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠা, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি সর্বদাই প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সীমাহীন অবদান ও ত্যাগ তাঁর প্রতি আমাদের মাথা নুইয়ে দেয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, ইতিহাসের পাঠ থেকে তিনি অনেকটাই বিস্মৃত।
১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রাম মৈস্তারকান্দিতে জন্ম নেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। পিতা গ্রাম্য কৃষক রাম দয়াল মন্ডল ও মাতা সন্ধ্যা দেবী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ যোগেনের বাল্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেণীতে বার্থী তারা ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিকুলেশন) পাস করেন। ওই বছরই বরিশাল বিএম কলেজে আইএ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ এবং ১৯২৯ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতা আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে প্রথমে কলকাতায় এবং একই বছর বরিশাল সদর আদালতে আইনজীবী হিসেবে তিনি যোগদান করেন। সেসময় হতেই তিনি সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির উন্নতি সাধনে যুক্ত হন জনসেবামূলক কাজকর্মে।
শোষিত-অনুন্নত, নির্যাতিত-নিপীড়িত, সামাজিকভাবে অবহেলিত, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাৎপদ, দরিদ্র-অর্থক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে নিম্নবর্গের মানুষদের দাবিদাওয়া সামনে রেখে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন। সাধারণ নির্বাচনে তিনিই প্রথম তফশিলি জাতির একমাত্র প্রতিনিধি যিনি সারা ভারতে আইনসভার একটি সাধারণ আসন দখল করতে পেরেছিলেন। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় বিধানসভায় তফশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘ইনডিপেনডেন্ট শিডিউলড কাস্ট পার্টি’ নামে একটি নিরপেক্ষ তফশিলি দল।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কংগ্রেসের চৌহদ্দিতেই ছিলেন তিনি। তিনি নেতাজি ও শরতচন্দ্র বসুর অনুগামী ছিলেন। ১৯৪০ সালে নেতাজিকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারের পর কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সদস্য হন যোগেন্দ্রনাথ। ঠিক তখনই বাবাসাহেব ড. আম্বেদকরের সঙ্গে হাত মেলান তিনি, খোলেন দলিত ফেডারেশনের বাংলা শাখা। তিনি ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় সমবায় ও ঋণদান বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্বভার পালন করেন ১৯৪৬ সালে। কাজ করেছেন বাংলার সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভায় ১৯৪৬ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। যোগেন ম-লের রাজনৈতিক জীবনের একটি অসাধারণ কীর্তি ছিল, ভারতের সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরকে পূর্ব বাংলার যশোর ও খুলনা থেকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনা। কংগ্রেস পণ করেছিল কোনো দলিতকে ভারতের ১৯৪৬ সালের গণপরিষদে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তফশীলী সমাজ ও মুসলমানদের ঐক্যের প্রধান নেতা হিসেবে ১৯৪৭ সালে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন করেন। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন হয়। এরপর তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ও অস্থায়ী সভাপতি হন। দলিত শ্রেণীর নেতা হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ কতকগুলো সাধারণ বিষয় নিয়ে মুসলিম লীগের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। এর ফলে দলিত শ্রেণীর লোকেরা লাভবান হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি নবগঠিত রাষ্ট্র, পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় আইন ও শ্রম মন্ত্রী হন। এর মাধ্যমে সরকার প্রশাসনে সর্বোচ্চ স্তরের হিন্দু সদস্য হন তিনি। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানি শাসকদের ভুল ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হতাশ ও বিতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি লিয়াকত খান মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি তার পদত্যাগের চিঠিতে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি সামাজিক অন্যায় ও পক্ষপাতমূলক আচরণ সম্পর্কিত ঘটনা উল্লেখ করেন। ১৯৬৮ সালে ভারতের চব্বিশ পরগনার স্বজাতি বন্ধুর বাড়িতে খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন তিনি। তড়িঘড়ি করে ফেরার সময় পথিমধ্যে মহাপ্রয়াণ ঘটে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের। চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা এলাকায় সমাহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে ‘মহাপ্রাণ’ খেতাবে ভূষিত করেন।
তিনি অবিভক্ত ভারতবর্ষে নতুন এক ‘সর্বজনবাদী/বহুজনবাদী’ (Inclusive) রাজনীতির সূচনা ঘটিয়েছিলেন প্রান্তিক জনপদ বাকেরগঞ্জ তথা পূর্ববঙ্গ থেকেই। এই রাজনীতিই তাঁকে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব দিয়েছে প্রদেশ, এমনকি কেন্দ্রেও। তাঁর কারণেই বিশেষত পূর্ববঙ্গের কৃষিপ্রজা দরিদ্র মুসলমান সমাজ সাতচল্লিশের ভাগাভাগির-রাজনীতির দর-কষাকষিতে প্রভাবশালী চরিত্র হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আজ ভারতে দলিত সমাজ একটা বড় রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে উঠেছে এবং উঠছে, যা মূলত সেটারই ফলাফল।
তিনি তার একটি বাণীতে লিখেছিলেন- ‘যদি আজ কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারে যে, আমার জীবনের বিনিময়ে আট কোটি তফসিলীর সার্বভৌম মুক্তি আসিবে। তবে আমি সে মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করিতে পারিব। যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে অথবা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাঙ্ক্ষা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।’
আমরা মনে করি, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের রাজনৈতিক আদর্শ এই মুহুর্তে বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলার নমঃশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা যোগেন মন্ডল সমাজের বঞ্চিততের ন্যায্য লড়াইয়ের ময়দানে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), কেন্দ্রীয় কমিটি।